
আশুরার দিনের ঘটনা ও ইতিহাস: ইসলামের আলোকে বিশ্লেষণ | আশুরার গুরুত্ব ও ফজিলত ২০২৫
পবিত্র আশুরা: ইতিহাস ও সহিহ হাদিসের আলোকে
আশুরা (১০ মুহররম) ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ দিন, যার পেছনে রয়েছে আল্লাহর সাহায্য, নবীদের বিজয় ও আত্মত্যাগের উজ্জ্বল স্মৃতি। রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখন তিনি দেখেন ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা রাখছে। এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন: “এই দিন আল্লাহ তাআলা নবী মূসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন।” তখন রাসুল (সা.) বলেন:
"نَحْنُ أَحَقُّ بِمُوسَى مِنْهُمْ"
“আমরা মূসার চেয়ে তার অনুসারী হওয়ার বেশি হকদার।”
তারপর তিনি আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং সাহাবাদেরও তা রাখার নির্দেশ দেন।
— (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২০০৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৩০)
এই হাদিসের ভিত্তিতে বোঝা যায়, আশুরা শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক দিন নয়, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য ও ন্যায়ের বিজয়ের দিন। এ দিনেই আল্লাহ মূসা (আ.)-কে নদী পার করান এবং জালেম ফেরাউনকে তার বাহিনীসহ ডুবিয়ে দেন (সূরা ইউনুস ১০:৯০-৯২)। তাই রাসুল (সা.) আশুরাকে গুরুত্ব দিয়ে রোজা রেখেছেন এবং পরবর্তী হিজরি বছরে ইহুদিদের থেকে ভিন্নভাবে পালন করার জন্য ৯ ও ১০ কিংবা ১০ ও ১১ মুহররমে রোজা রাখার উপদেশ দেন (মুসনাদে আহমদ: ২১৫৪)।
তাছাড়া আশুরার দিন আরও কিছু নবীর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয় বলে হাদিসে উল্লেখ আছে। যেমন:
- আদম (আ.)-এর তওবা কবুল,
- নুহ (আ.)-এর কিস্তি জুদি পাহাড়ে থামা,
- ইব্রাহিম (আ.)-এর আগুন থেকে মুক্তি,
- ঈসা (আ.)-এর আকাশে উত্তোলন ইত্যাদি।
এছাড়া ইসলামের ইতিহাসে আশুরা দিনটি গভীর বেদনারও স্মারক, কারণ ৬১ হিজরির এই দিনেই ইমাম হুসাইন (রা.) কারবালার ময়দানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শহীদ হন। এই ত্যাগ মুসলিমদের শিক্ষা দেয়, সত্য ও ইনসাফের পক্ষে থাকতে হলে জীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগও করতে হতে পারে।
আশুরার তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা
আরবি হিজরি বর্ষের প্রথম মাস হলো মুহররম, যা ইসলামে বিশেষ সম্মানিত ও ফজিলতপূর্ণ মাস। ইসলামি পরিভাষায় মুহররমের ১০ তারিখকে বলা হয় “আশুরা”। সৃষ্টির শুরু থেকেই আশুরার দিনে বহু গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে—যেমন, নবীদের মুক্তি, তওবা কবুল, ও আল্লাহর বিশেষ রহমত। ফলে এই দিনটির মর্যাদা ও মাহাত্ম্য যুগে যুগে মুসলিম সমাজে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষভাবে, ৬১ হিজরির এই আশুরার দিনেই, ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে ঘটেছিল মানব ইতিহাসের এক হৃদয়বিদারক অধ্যায়—রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় নাতি, হজরত হুসাইন (রা.) শহীদ হন। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আত্মত্যাগ করেন। এই আত্মত্যাগ আশুরাকে মুসলিম ও মানবজাতির কাছে এক স্মরণীয় ও বরণীয় দিন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
কারবালার ইতিহাস: কেন শহীদ হন ইমাম হুসাইন (রা.)?
ইমাম হুসাইন (রা.) ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নাতি, ফাতিমা (রা.) ও আলি (রা.)-এর পুত্র। ৬০ হিজরিতে উমাইয়া বংশের শাসক মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান মৃত্যুবরণ করেন এবং তার পুত্র ইয়াজিদ খিলাফতের দাবিদার হন। তিনি ইসলামি শাসনের গুণাবলি না থাকার পরও বলপূর্বক ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং নিজের নামের বাইয়াত (আনুগত্য স্বীকার) জোর করে আদায় করতে থাকেন।
ইমাম হুসাইন (রা.) বাইয়াত দিতে অস্বীকৃতি জানান, কারণ তিনি মনে করেন:
"ইসলামের শাসন ব্যক্তি স্বার্থের জন্য নয়, এটি আল্লাহর বিধানের প্রতিনিধিত্ব।"
কারবালার দিকে যাত্রা
ইরাকের কুফা শহরের মানুষজন চিঠি লিখে হুসাইন (রা.)-কে আমন্ত্রণ জানান, যে তারা ইয়াজিদের অন্যায় শাসনের পরিবর্তে তাঁকেই খলিফা হিসেবে মানতে প্রস্তুত। হুসাইন (রা.) নিজের প্রতিনিধি মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় পাঠান পরিস্থিতি যাচাই করতে।
প্রথমে মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফার মানুষ সমর্থন জানালেও ইয়াজিদের গভর্নর উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে মুসলিমকে শহীদ করেন। হুসাইন (রা.) তখন কুফার উদ্দেশে রওনা দেন, কিন্তু মাঝপথে জানতে পারেন যে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।
কারবালার ময়দানে অবস্থান
৬১ হিজরির ১০ মহররম, হুসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবারসহ প্রায় ৭২ জন সঙ্গী ইরাকের কারবালা নামক স্থানে ইয়াজিদের ৪ হাজার সৈন্যবাহিনী দ্বারা ঘিরে ফেলেন। তাদেরকে পানি পেতে বাধা দেওয়া হয়। এরপর হুসাইন (রা.) শান্তিপূর্ণভাবে সমঝোতার চেষ্টা করলেও ইয়াজিদ বাহিনী যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়।
এই মর্মান্তিক যুদ্ধে ইমাম হুসাইন (রা.) একে একে তাঁর ভাই, ভ্রাতুষ্পুত্র, পুত্র, আত্মীয় ও সাহাবিদের হারান। অবশেষে তিনি নিজেও শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর ছেলে ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) গুরুতর অসুস্থ থাকায় বেঁচে যান।
হুসাইন (রা.) কেন শহীদ হলেন?
কারণ: তিনি অন্যায়, অত্যাচার ও ইসলামবিরোধী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি কখনো অন্যায় শাসকের কাছে মাথানত করেননি। তাঁর শাহাদাত একটি সত্যিকারের প্রতিবাদের প্রতীক, যা ইসলামি আদর্শ, ন্যায়বিচার ও আত্মত্যাগের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত।
ইবনে কাসীর ও তাবারির বিবরণে
ইতিহাসবিদ ইবনে কাসীর (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া) ও তাবারি তাঁদের গ্রন্থে লিখেছেন:
“ইয়াজিদ ইসলামী নেতৃত্বের যোগ্য ছিলেন না। তিনি খেলাফতকে রাজতন্ত্রে পরিণত করেছিলেন।”
হুসাইন (রা.) বলেন:
"আমি তো সংস্কারের উদ্দেশ্যে বের হয়েছি, দাদা রাসুল (সা.)-এর উম্মতের মধ্যে। আমি চাই, ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায় রোধ।"
আশুরার দিনে কী কী ঘটেছিল? — সহিহ হাদিস ও ইতিহাসের আলোকে
১। নবী মূসা (আ.) ও বনি ইসরাইলের মুক্তি
✅ সহিহ হাদিস:
রাসুলুল্লাহ ﷺ যখন মদিনায় হিজরত করলেন, তখন দেখলেন ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখছে। কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলল—
"এই দিন আল্লাহ তাআলা মূসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে মুক্তি দিয়েছেন এবং ফেরাউনকে ডুবিয়ে দিয়েছেন।"
রাসুল ﷺ বললেন,
"نَحْنُ أَحَقُّ بِمُوسَى مِنْكُمْ"
“আমরা মূসার চেয়ে বেশি হকদার।”
তিনি নিজে রোজা রাখেন এবং সাহাবিদেরও রোজা রাখতে বলেন।
📚 [সহিহ বুখারি: ২০০৪, সহিহ মুসলিম: ১১৩০]
🔹 এটি আশুরার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও হাদিসভিত্তিক ঐতিহাসিক ঘটনা।
২। এক বছরের গোনাহ মোচনের রোজা
✅ রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“আমি আশা করি, আশুরার রোজা বিগত বছরের গোনাহ মোচন করে দেয়।”
📚 [সহিহ মুসলিম: ১১৬২]
🔹 আশুরার দিনে রোজা রাখলে আল্লাহ তাআলা গত এক বছরের ছোট (সগিরা) গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন।
৩। কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা – ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত
🔴 ৬১ হিজরি সালের ১০ মুহররম, ইরাকের কারবালা প্রান্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় নাতি ইমাম হুসাইন (রা.) ৭২ জন সঙ্গীসহ ইয়াজিদের বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন। যদিও এই ঘটনা হাদিসে পূর্বনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নেই, তবে বিশুদ্ধ ইসলামি ইতিহাসে এটি সুপ্রতিষ্ঠিত।
📚 [ইবনু কাসীর, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া; তাবারির ইতিহাস]
৪। অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাবলী (হাদিস নয়, ইতিহাসবিদদের বর্ণনা):
বহু প্রাচীন ইসলামি ইতিহাসবিদ যেমন ইবনু জাওজি, ইবনু কাসীর, ইবনে আবি শাইবা ইত্যাদি উল্লেখ করেছেন যে আশুরার দিন আরও নিম্নলিখিত ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়েছিল (এগুলো হাদিস দ্বারা নয়, ইতিহাস থেকে পাওয়া):
🔹 আদম (আ.)-এর তওবা কবুল
🔹 নুহ (আ.)-এর কিশতী জুদি পাহাড়ে স্থির হওয়া
🔹 ইব্রাহিম (আ.)-কে আগুন থেকে মুক্ত করা
🔹 ইউনুস (আ.)-কে মাছের পেট থেকে মুক্তি
🔹 ঈসা (আ.)-কে আকাশে উঠিয়ে নেওয়া
🔹 আইয়ুব (আ.)-এর রোগ থেকে মুক্তি
🔹 ইউসুফ (আ.)-কে কূপ থেকে উদ্ধার করা
🔹 ইবনু ইয়াকূব (ইউসুফ) ফিরে পাওয়া,
🔹 সুলায়মান (আ.)-এর রাজত্ব প্রতিষ্ঠা,
🔹 ঈসা (আ.)-র স্বর্গ উত্তোলন ইত্যাদি।
➡ তবে এগুলোর ভিত্তিতে আশুরার রোজা রাখার বিধান নেই, কারণ এগুলো সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়।
আশুরার দিনে ঘটেছিল:
- নবী মূসা (আ.)-এর মুক্তি – হাদিস দ্বারা প্রমাণিত
- রোজা রাখলে এক বছরের গোনাহ মোচন – সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত
- ইমাম হুসাইনের শাহাদাত – ইতিহাস দ্বারা প্রমাণিত
- অন্য নবীদের ঘটনা – ইতিহাসবিদদের বর্ণনায় উল্লেখিত, তবে হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়।
কারবালা আমাদের কী শেখায়?
- সত্য ও ইনসাফের পক্ষে দৃঢ় থাকা
- ভয় ও নির্যাতনের মুখেও আপস না করা
- ইসলামি শাসনের প্রকৃত রূপ রক্ষা করা
- আত্মত্যাগের মহান আদর্শ
কারবালা শুধু শোকের নয়, সত্য ও ন্যায়ের জন্য আত্মত্যাগের এক মহান ইতিহাস। ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত আমাদের শিক্ষা দেয়, ইসলামী আদর্শের জন্য জীবন উৎসর্গ করাও পরম মর্যাদার। এই আত্মত্যাগ কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহকে সত্য ও ন্যায়ের পথে অনুপ্রাণিত করে যাবে।
আশুরা ইসলামে শুধুমাত্র ইতিহাস নয়, এটি ঈমান, ত্যাগ, আত্মশুদ্ধি ও ন্যায়বিচারের জীবন্ত প্রতীক। নবীদের জীবন, রাসুল (সা.)-এর আদর্শ এবং ইমাম হুসাইনের শাহাদাত আমাদের শেখায়—আল্লাহর উপর আস্থা, সত্যের পথে দৃঢ় থাকা, এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদই ঈমানদারের গুণ। তাই আশুরার দিনে রোজা রাখা, নফল ইবাদত, দান-সদকা ও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে এ দিনের তাৎপর্য বুঝে পালন করা উচিত।
FAQs (প্রশ্নোত্তর):
প্রশ্ন ১: আশুরা কাকে বলে?
উত্তর: আশুরা হলো হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মুহররমের ১০ তারিখ। এটি ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন, যেদিন বহু ঐতিহাসিক ও ইসলামি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
প্রশ্ন ২: আশুরার দিনে কী কী ঘটনা ঘটেছে?
উত্তর: সহিহ হাদিস অনুযায়ী, এদিন আল্লাহ তাআলা নবী মূসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। ইসলামি ইতিহাস অনুসারে, এই দিনেই ইমাম হুসাইন (রা.) কারবালায় শহীদ হন।
প্রশ্ন ৩: আশুরার রোজার গুরুত্ব কী?
উত্তর: রাসুল (সা.) বলেছেন, আশুরার রোজা গত এক বছরের গুনাহ মোচন করে দেয়। (সহিহ মুসলিম)
প্রশ্ন ৪: আশুরার দিনে রোজা ফরজ কি?
উত্তর: না, এটি ফরজ নয়; তবে এটি একটি ফজিলতপূর্ণ সুন্নত রোজা, যেটি নবী করিম (সা.) নিজে পালন করেছেন ও উম্মতকে উৎসাহ দিয়েছেন।
প্রশ্ন ৫: আশুরার সাথে কারবালার সম্পর্ক কী?
উত্তর: ৬১ হিজরির ১০ মুহররম তারিখে কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শহীদ হন। এ কারণে আশুরার দিনটি মুসলিমদের কাছে আত্মত্যাগ ও ন্যায়ের প্রতীক।
মন্তব্য করুন
Your email address will not be published.