
পদ্মা সেতুর টোল হালনাগাদ 2025 ও গাড়ি চলাচলের নতুন নিয়মাবলি
পদ্মা সেতুর টোল হালনাগাদ ও গাড়ি চলাচলের নিয়ম 2025
বাংলাদেশের গর্বের প্রতীক পদ্মা সেতু এখন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এক প্রধান চালিকাশক্তি। ২০২২ সালের ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সেতু উদ্বোধন করেন এবং ২৬ জুন থেকে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এর পর থেকে এই সেতু দিয়ে লাখ লাখ যানবাহন চলাচল করেছে।
২০২৫ সালে পদ্মা সেতুতে টোল এবং গাড়ি চলাচলের নিয়মে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে, যা জানা প্রতিটি গাড়িচালক ও যাত্রীর জন্য জরুরি।
পদ্মা সেতু ব্যবহার করতে হলে প্রতিটি যানবাহনকে একটি নির্ধারিত পরিমাণ টোল (মূল্য) প্রদান করতে হয়। যদিও এই টোল তুলনামূলকভাবে বেশি, তবুও সময় সাশ্রয় মানেই অর্থ সাশ্রয় – এই নীতিতে দেশের অনেক পরিবহন সংস্থা ও যাত্রীরা সেতুটি ব্যবহার করছেন।
সাধারণ ফেরি পারাপারে যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লেগে যেত, সেখানে এখন পদ্মা সেতু দিয়ে মাত্র কয়েক মিনিটে পদ্মা নদী পার হওয়া সম্ভব। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, পণ্য পরিবহন এবং ব্যক্তিগত যাতায়াত – সব ক্ষেত্রেই দ্রুততা ও নির্ভরযোগ্যতার এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে এই সেতু।
পদ্মা সেতু বা পদ্মা বহুমুখী সেতু হচ্ছে বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মিত একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। এর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা যুক্ত হয়েছে। সেতুটি ২০২২ সালের ২৫ জুন উদ্বোধন করা হয়। এই দিন সেতুটি উন্মুক্ত করা হয়। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত। দুই স্তর বিশিষ্ট ইস্পাত ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাসের এই সেতুর উপরের স্তরে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরে একটি একক রেলপথ রয়েছে। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় তৈরি সেতুটি ৪১টি স্প্যান নিয়ে গঠিত, প্রতিটি স্প্যান লম্বায় ১৫০.১২ মিটার (৪৯২.৫ ফুট) এবং চওড়ায় ২২.৫ মিটার (৭৪ ফুট)। সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিমি (৩.৮২ মাইল)। এটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু, স্প্যান সংখ্যা ও মোট দৈর্ঘ্য উভয়ের দিক থেকে গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত দীর্ঘতম সেতু এবং ১২০ মিটার (৩৯০ ফুট) গভীরতাযুক্ত বিশ্বের গভীরতম পাইলের সেতু। সেতুটি চালু হওয়ার পর বাংলাদেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পদ্মা সেতুর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
- দৈর্ঘ্য: ৬.১৫ কিলোমিটার
- প্রস্থ: ১৮.১৮ মিটার
- লেন: ৪টি (দুটি যানবাহনের জন্য, দুটি রেল ও সার্ভিস লেন)
- নির্মাণ ব্যয়: প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা
- প্রধান ব্যবহার: সড়ক ও রেলপথ উভয়
পদ্মা সেতুর গঠন ও নির্মাণ সংক্ষেপ
পদ্মা সেতু, যা পুরো নাম “পদ্মা বহুমুখী সেতু”, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও জটিল নির্মাণ প্রকল্প। এটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য অংশের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করেছে।
নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
- উদ্বোধন: ২৫ জুন ২০২২
- প্রথম যাত্রা: শেখ হাসিনা নিজে টোল দিয়ে সেতুতে যাত্রা করেন
- সেতুর ধরণ: ট্রাস-ভিত্তিক ইস্পাত ও কংক্রিট নির্মিত
- লেন ব্যবস্থা: উপরের স্তরে ৪-লেন সড়ক ও নিচের স্তরে একক রেলপথ
- দৈর্ঘ্য: ৬.১৫ কিমি (বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু)
- প্রস্থ: ২২.৫ মিটার
- স্প্যান সংখ্যা: ৪১টি (প্রতিটি ১৫০.১২ মিটার দৈর্ঘ্য)
- গভীরতা: ১২০ মিটার – এটি বিশ্বের সবচেয়ে গভীর পাইল ভিত্তিক সেতুগুলোর একটি
এই সেতু শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তিগত কীর্তি নয়, বরং এটি জাতীয় আত্মমর্যাদা ও সক্ষমতার প্রতীক। নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এই সেতু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
অর্থনৈতিক প্রভাব ও সময় সাশ্রয়ের হিসাব
যদিও সেতু ব্যবহার করতে হয় টোল দিয়ে, তবুও যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের মতে, এটি সময় ও অর্থ উভয়েরই সাশ্রয় করছে। কেননা:
- ফেরি সার্ভিসের বিকল্প: ফেরির দীর্ঘ লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা এখন অতীত
- সময় বাঁচায়: ঢাকা থেকে খুলনায় এখন মাত্র ৪-৫ ঘণ্টায় পৌঁছানো যায়
- ইন্ধন সাশ্রয়: কম সময়ে পৌঁছানোর ফলে জ্বালানি খরচও কমে
- ব্যবসার গতি বৃদ্ধি: কৃষি পণ্য, মাছ, পোশাকসহ সব ধরণের মালামাল দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব
সরকার আশা করছে, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের জিডিপি প্রায় ১.২% বৃদ্ধি পাবে, যা একটি অভাবনীয় অর্জন।
২০২৫ সালের পদ্মা সেতুর টোল চার্ট (হালনাগাদ)
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী ২০২৫ সালের টোল রেট নিম্নরূপ:
যানবাহনের ধরণ | একমুখী টোল (BDT) |
---|---|
মোটরসাইকেল | ১০০ |
ব্যক্তিগত গাড়ি/জীপ | ৭৫০ |
মাইক্রোবাস | ১,৩০০ |
মিনিবাস (≤৩১ আসন) | ১,৪০০ |
বাস (৩১ আসনের বেশি) | ২,০০০ |
হালকা ট্রাক (≤৫ টন) | ১,৬০০ |
মাঝারি ট্রাক (৫-৮ টন) | ২,১০০ |
ভারী ট্রাক (৮-১১ টন) | ২,৮০০ |
অতি ভারী ট্রাক (১১ টনের বেশি) | ৬,০০০ |
ট্রেইলার (৪ এক্সেল) | ৬,০০০ |
ট্রেইলার (প্রতি অতিরিক্ত এক্সেল) | ১,৫০০ |
🔁 নোট: টোল রেট একমুখী ভ্রমণের জন্য নির্ধারিত এবং তা ফেরি টোলের তুলনায় ১.৫ গুণ পর্যন্ত হতে পারে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত টোল ফি

সুত্রঃ বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ওয়েবাইট
গাড়ি চলাচলের সময়সূচি ও নিয়মাবলি (২০২৫ হালনাগাদ)
পদ্মা সেতু দিয়ে ২৪ ঘণ্টা যান চলাচল করা গেলেও কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলা বাধ্যতামূলক:
চালকের জন্য নিয়মাবলি:
- সর্বোচ্চ গতি: ব্যক্তিগত গাড়ি: ৬০ কিমি/ঘণ্টা, বাস ও ট্রাক: ৪০ কিমি/ঘণ্টা
- ওভারটেকিং নিষিদ্ধ: সেতুতে ওভারটেক করা দণ্ডনীয় অপরাধ।
- হাতের বাইরে থাকা বস্তু নিষিদ্ধ: বাস-ট্রাকের ছাদে বা বাহিরে কোনো মালামাল বহন করা যাবে না।
- মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ: চালকরা মোবাইল ফোনে কথা বললে জরিমানা করা হবে।
- নির্ধারিত লেনে চলা বাধ্যতামূলক
নিষিদ্ধ যানবাহন:
- রিকশা, সাইকেল
- পায়ে হাঁটা (walkway নেই)
- পশুবাহী গাড়ি
টোল পরিশোধ পদ্ধতি
২০২৫ সালে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পদ্মা সেতুতে ইলেকট্রনিক টোল কালেকশন (ETC) সিস্টেম চালু হয়েছে। এতে করে টোল প্লাজার জ্যাম অনেকটাই কমেছে।
পদ্ধতি:
- ETC কার্ড: অগ্রিম টাকা জমা দিয়ে রেজিস্টার করতে হয়।
- ক্যাশ টোল: নগদে পরিশোধ করা যাবে নির্ধারিত বুথে।
পদ্মা সেতু কোন কোন জেলাকে যুক্ত করেছে?
সেতুটি ঢাকা ও মাওয়া প্রান্তকে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা ও দক্ষিণাঞ্চলের অন্যান্য জেলার সাথে সংযুক্ত করেছে। এখন ঢাকা থেকে খুলনা যাত্রায় সময় লাগে মাত্র ৪-৫ ঘণ্টা।
জরুরী নিরাপত্তা ব্যবস্থা
পদ্মা সেতুর ওপর সিসিটিভি, ট্রাফিক পুলিশ, র্যাব ও আর্মড ফোর্সেস সার্বক্ষণিক নিয়োজিত। অতিরিক্ত গতির বিরুদ্ধে স্পিড গান ব্যবহার করে জরিমানা করা হয়।
পদ্মা সেতু দিয়ে দৈনিক গড় গাড়ি চলাচল (২০২৫)
বিআইটিসিএল এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে পদ্মা সেতু দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৩৫,০০০+ গাড়ি চলাচল করছে। এই সংখ্যা ঈদ বা সরকারি ছুটিতে ৫০,০০০ ছাড়িয়ে যায়।
আরো পড়ুনঃ
বাংলাদেশের নতুন শিক্ষা কারিকুলাম ২০২৫ – ইতিহাস, বৈশিষ্ট্য ও বাস্তবায়ন বিশ্লেষণ
পদ্মা সেতুর প্রভাব: অর্থনীতি ও যোগাযোগ
অর্থনৈতিক প্রভাব:
- দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিপণ্য দ্রুত রাজধানীতে পৌঁছায়
- শিল্প, ব্যবসা ও কর্মসংস্থানের উন্নয়ন
- পর্যটন শিল্পে বিকাশ
যোগাযোগ সুবিধা:
- ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক সময় বাঁচায়
- ফেরি নির্ভরতা কমে গেছে
- ট্রেন লাইন চালু হওয়ার প্রস্তুতি চলছে (পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্প)
পদ্মা সেতুর জরুরি হেল্পলাইন নম্বর
বিভাগ | নম্বর |
---|---|
সেতু নিয়ন্ত্রণ কক্ষ | ১৩৩৩ |
ট্রাফিক পুলিশ | ৯৯৯ |
অ্যাম্বুলেন্স | ১৬২৬৩ |
দমকল | ০১৯৭৪-২২৯৯৯৯ |
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলি (FAQs)
১. পদ্মা সেতুর মোট টোল কত?
➡️ এটি যানবাহনের ধরণ অনুসারে ভিন্ন। ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য ৭৫০ টাকা, ট্রেইলার ট্রাকের জন্য ৬০০০ টাকা পর্যন্ত।
২. পদ্মা সেতু দিয়ে কি মোটরসাইকেল চলতে পারে?
➡️ হ্যাঁ, তবে নির্ধারিত দিনে ও সময়সূচিতে চলাচল করতে হয়।
৩. পদ্মা সেতুতে গাড়ির গতি কত হওয়া উচিত?
➡️ ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য সর্বোচ্চ ৬০ কিমি/ঘণ্টা, ভারী যানবাহনের জন্য ৪০ কিমি/ঘণ্টা।
৪. কীভাবে টোল পরিশোধ করতে হয়?
➡️ নগদ কিংবা ইলেকট্রনিক টোল কালেকশন (ETC) সিস্টেম ব্যবহার করে।
৫. পদ্মা সেতুতে পায়ে হেঁটে চলা যায় কি?
➡️ না, এটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
পদ্মা সেতু কেবল একটি অবকাঠামো নয়, এটি বাংলাদেশে যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম মাইলফলক। ২০২৫ সালে সেতুর টোল হালনাগাদ ও গাড়ি চলাচলের নিয়ম জানার মাধ্যমে আপনি সহজে নিরাপদভাবে এই রুটে যাতায়াত করতে পারবেন।
সেতু ব্যবহার করার আগে সর্বশেষ টোল চার্ট ও ট্রাফিক নির্দেশনা জেনে নেওয়া প্রতিটি চালকের দায়িত্ব। সতর্কতার সাথে নিয়ম মেনে চলুন, নিজে নিরাপদ থাকুন, অন্যকেও নিরাপদ রাখুন।
মন্তব্য করুন
Your email address will not be published.