
বাংলাদেশে ইসলাম আগমনের ইতিহাস ও সুফিদের ভূমিকা
বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ও সুফীদের ভূমিকা
নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জীবনকাল ও পরবর্তী ইসলাম প্রচারের ফলে মাত্র ৫০ বছর পর, অর্থাৎ ৬২০ খ্রিষ্টাব্দের আশেপাশে বাংলাদেশ অঞ্চলে ইসলাম প্রবেশ শুরু হয়।
এই সময়কালকে ভিত্তি করে ইতিহাস ও প্রাচীন শিলালিপির মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলার পঞ্চগ্রামে দেশের প্রথম মসজিদ নির্মিত হয় ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে, যার নাম ছিল সাহাবায়ে কেরাম জামে মসজিদ। ১৯৮৭ সালে পঞ্চগ্রামে এক জঙ্গল খননের সময় মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল, যেখানে কালেমা তাইয়্যেবা ও ৬৯ হিজরি খ্রিষ্ট লিপি ছিল।
বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের আগমন একটি দীর্ঘ ও ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। আরব থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া ইসলামের এই পথ চলা দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ করে বঙ্গভূমিতে নানা রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশ অঞ্চলে ইসলাম এসেছে বিভিন্ন সময় ও নানা উৎস থেকে, যার প্রধান মাধ্যম ছিল বণিক ও সুফি মুরুব্বিরা। এই পোষ্টে আমরা বিস্তারিত জানব কিভাবে বাংলাদেশে ইসলাম প্রবেশ করেছিল এবং এর পরিণতি কী ছিল।
বাংলাদেশ বা প্রাচীন বঙ্গভূমি ছিল ভারতের অংশ, যেখানে ৭ম শতকের শেষ ভাগ থেকে ইসলাম প্রবেশের চিহ্ন পাওয়া যায়। তবে সরাসরি আরব বিজয় বা উপনিবেশ ছিল না এই অঞ্চলে। ৭০০ সালের দিকে আরব বণিক ও ব্যবসায়ীরা বঙ্গের উপকূলে এসে পৌঁছান। তারা স্থানীয়দের সাথে বানিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময় শুরু করেন। এই বণিকদের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ইসলামিক ধারণাগুলো ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে ইসলামের আগমন কোনো একদিনে সংঘটিত ঘটনা ছিল না। এটি ছিল দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিকাশের ফল। সপ্তম শতক থেকে শুরু করে দ্বাদশ শতকে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইসলাম বাংলায় রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে তারও বহু আগে আরব বণিক ও সুফি সাধকেরা ইসলামের বীজ বপন করেছিলেন এই ভূখণ্ডে।
বাংলাদেশে ইসলাম কিভাবে আসে?
১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী তৎকালীন বাংলার সেন বংশীয় রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে ইসলামের বিজয় কেতন উড্ডীন করেন। খিলজী বিজিত রাজ্যের সীমানা ছিল-উত্তরে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত পূর্ণিয়া শহর হয়ে দেবকোট থেকে রংপুর শহর, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে তিস্তা ও করতোয়া, দক্ষিণে গঙ্গার মূলধারা বা পদ্মা এবং পশ্চিমে কুশী নদীর নিম্নাঞ্চল থেকে গঙ্গার কিনারায় রাজমহল পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত।
খিলজীর এ বিজয়ের ফলে বাংলায় ইসলাম ব্যাপকভাবে পরিচিত ও প্রসারিত হয়। এ সময় থেকে দলে দলে মুসলিমরা বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেন এবং ইসলাম প্রচার কাজ শুরু করেন।
ঐতিহাসিকদের অপর এক দলের মতে বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটে খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতক থেকে দশম শতকের মধ্যেই এবং ধীরে ধীরে তা প্রসারিত হয়। বাংলাদেশে ইসলামের প্রাথমিক পরিচিতি ও প্রচারকার্য পরিচালিত হয় আরব মুসলিম বণিকদের মাধ্যমে।
মুসলিম বিজয় পূর্ব বাংলায় আগত বণিকরাই এ দেশে ইসলামের পরিচয় তুলে ধরেন। এ দেশে ইসলাম আগমনের প্রধান মাধ্যম ছিল আরব-ভারত-চীন বাণিজ্য সম্পর্ক। জাহিলিয়াতের যুগ থেকেই আরব বণিকদের সঙ্গে এ অঞ্চলের বাণিজ্য সম্পর্ক প্রচলিত ছিল।
রাসূল (সা.) ভারতীয় সুগন্ধি দ্রব্য উপহার হিসাবে লাভ করেন বলেও প্রমাণ পাওয়া যায়। ভূগোলবিদরা আরব-ভারত-চীন বাণিজ্য পথের নানা বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, আরব-চীন বাণিজ্য যাত্রার মূল সূত্র ছিল ভারতবর্ষ। আরব বণিকরা পারস্য উপসাগর হয়ে বেলুচিস্তানের একটি বন্দরে প্রবেশ করতেন।
তারপর একে একে সিন্ধু, গুজরাট, মাদ্রাজ ও কলকাতা বন্দরে প্রবেশ করে বঙ্গোপসাগরে উপনীত হতেন। তারা এ সময় ওই অঞ্চলের সিলাহাত বা বর্তমান সিলেট ও সাদজাম বা বর্তমান চট্টগ্রাম বন্দরে যাত্রাবিরতি করতেন। এরপর তারা চীন সাগরে প্রবেশ করতেন।
এভাবেই আরব থেকে চীন পর্যন্ত বাণিজ্যযাত্রায় ভারত উপমহাদেশ ও বঙ্গদেশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। আরবরা মধ্যবর্তী এসব বন্দরেও তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতেন ও সফরের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ করতেন।
আরব ঐতিহাসিক ও ভূগোলবিদদের বর্ণনায়ও বাংলার নানা স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। ভূগোলবিদ ইবনে খুরদাদবিহ তার বর্ণনায় বাংলাদেশের চাঁদপুর নদী বন্দরের কথা উল্লেখ করেছেন। আল ইদ্রিসীর বর্ণনায় রয়েছে-বাগদাদ ও বাসরা থেকে আরব বণিক এবং পর্যটকরা মেঘনার মোহনার সন্নিকটস্থ অঞ্চলে আসা-যাওয়া করতেন। বস্তুত মহানবি (সা.)-এর নবুয়তপূর্ব বহুকাল ধরেই আরব-ভারত-চীন বাণিজ্য সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। ইসলামের আবির্ভাবের পরও এ সম্পর্ক অব্যাহত ছিল।
আরব মুসলিম বণিকরা তৎকালে এ পথ ধরেই বাণিজ্যযাত্রা অব্যাহত রাখেন। ফলে ইসলামের আবির্ভাবের অল্পকালের মধ্যেই ভারতবর্ষে তথা বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটে। বাণিজ্য উপলক্ষ্যে আগমন করলেও আগত এসব আরব মুসলিম বণিক এ দেশের জনগণের মধ্যে ইসলাম প্রচারের সুযোগ হাতছাড়া করেননি। তারা যেসব বন্দরে যাত্রাবিরতি করতেন সেখানে ইসলামের প্রচার করতেন। এভাবে খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকেই বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটে।
ছবিঃ প্রাচীন মানচিত্র বাংলাদেশ
রংপুর জেলার ইতিহাস অনুযায়ী, রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মামা, মা আমেনার চাচাতো ভাই, সাহাবি আবু ওয়াক্কাস (রা.) ৬২০ থেকে ৬২৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করেন। এই সময়ের মধ্যেই পঞ্চগ্রামের মসজিদ নির্মিত হওয়ার বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত।
এটি প্রমাণ করে যে, ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন খিলজীর বাংলা বিজয়ের প্রায় ৬০০ বছর আগে থেকেই এদেশে ইসলাম প্রচারিত ছিল।
ঐতিহাসিক মসজিদসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রাচীন মসজিদ ইসলামিক স্থাপত্য ও ইতিহাসের প্রমাণ স্বরূপ দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- আবু আক্কাস মসজিদ (৬৪৮ খ্রিস্টাব্দ)
- সোনা মসজিদ (১৪৯৩)
- বাঘা মসজিদ (১৫২৩)
- ষাট গম্বুজ মসজিদ (১৫শ শতক)
- লালবাগ কেল্লা (১৬৬৪)
এই মসজিদগুলো বাংলার মুসলিম সভ্যতার ঐতিহাসিক নিদর্শন।
বিস্তারিত পড়ুনঃ
ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাস ও প্রতিষ্ঠার বিস্তারিত বিবরণ
সুফীতত্ত্ব ও ইসলামের বিস্তার
১৩শ শতকের শুরুতে বাংলাদেশে সুফি-আওলিয়াদের আগমন ঘটে। ইসলামের শান্তিপূর্ণ দাওয়াত এবং সুফি সাধকদের মানবসেবামূলক কাজ বাংলার মানুষকে ইসলাম গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে।
মুঘলদের বাংলা বিজয় ও উত্তর ভারতের ইসলামী শাসনগঠন, বিশেষ করে সৈয়দ শাহ নাসিরুদ্দিনের মতো সুফি মুরুব্বিদের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তাঁরা স্থানীয় জনপদে ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের শান্তিপূর্ণ দাওয়াহ ও পরোপকারমূলক কাজ মুসলিম ধর্মকে সহজে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল।
বিশিষ্ট সুফি মুরব্বিরা যেমন: শাহজালাল (রহঃ), শাহ মুঈনুদ্দিন, খানজাহান আলী। সুফিদের কারিশমা, শিক্ষা ও মানবিকতা মানুষের মনে ইসলাম গ্রহণের পথ সুগম করেছিল।
রাজনৈতিক ও সামরিক বিজয়
- ১৩১০ সালের দিকে তখতু বাংলার সেনাপতি বখতিয়ার খলজী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তার বিজয়ের মাধ্যমে বাংলা মুসলিম শাসনের আওতায় আসে এবং ইসলাম বিস্তারে সহায়ক হয়।
- বখতিয়ার খলজীর বিজয় ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বেনগল অঞ্চলে।
- এর পর গড়ে ওঠে মসজিদ, মাদ্রাসা ও ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
- ইসলামি শাসন ব্যবস্থার কারণে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড ও সম্প্রদায়ের গঠন সহজ হয়।
সংস্কৃতি ও সমাজে ইসলাম
- ইসলাম ধর্মের আগমনে বাংলাদেশে নতুন ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আসে:
- মুসলিম সমাজে জামে মসজিদ, পীর মাজার ও দরবেশ খানাগুলো গড়ে ওঠে।
- ইসলামী ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতির মিশ্রণ হয়।
- বাংলা সাহিত্যে ইসলামী ভাবনা ও শ্লোকের প্রবাহ বৃদ্ধি পায়।
উপসংহার
বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ছিল ধীরে ধীরে সংঘটিত একটি প্রক্রিয়া। বণিক, সুফি এবং সামরিক বিজয়ের সমন্বয়ে মুসলিম ধর্ম বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ধীরে ধীরে এ অঞ্চলের বৃহত্তর অংশে বিস্তার লাভ করে। আজকের বাংলাদেশে ইসলাম দেশের প্রধান ধর্ম হিসেবে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ।
❓ প্রশ্নোত্তর (FAQ)
🟢 প্রশ্ন ১: বাংলাদেশে ইসলাম কবে আসে?
উত্তর: ইতিহাসবিদদের মতে, বাংলাদেশে ইসলাম প্রথম আসে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে আরব মুসলিম বণিকদের মাধ্যমে। তবে রাজনৈতিকভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের মাধ্যমে।
🟢 প্রশ্ন ২: বাংলাদেশে প্রথম ইসলাম প্রচার করেন কে?
উত্তর: সাহাবা আবু ওয়াক্কাস (রা.)-কে অনেকে বাংলাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক হিসেবে মনে করেন। তিনি ৬২০–৬২৬ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম প্রচারে আসেন বলে রংপুরের ইতিহাসে উল্লেখ আছে।
🟢 প্রশ্ন ৩: বাংলাদেশে প্রথম মসজিদ কোথায় নির্মিত হয়?
উত্তর: ধারণা করা হয়, দেশের প্রথম মসজিদ নির্মিত হয় লালমনিরহাট জেলার পঞ্চগ্রামে ‘মজেদের আড়া’ গ্রামে। ৬৯০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত এই মসজিদটির নাম সাহাবায়ে কেরাম জামে মসজিদ।
🟢 প্রশ্ন ৪: ইসলামের আগমন কি খিলজীর বিজয়ের আগেই হয়েছিল?
উত্তর: হ্যাঁ, খিলজীর বিজয়ের (১২০৪ খ্রিঃ) অনেক আগেই আরব বণিক ও সুফিদের মাধ্যমে ইসলাম বাংলায় প্রচারিত হয়েছিল। খিলজীর বিজয়ের মাধ্যমে তা প্রশাসনিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
🟢 প্রশ্ন ৫: সুফিদের ভূমিকা কী ছিল ইসলামের প্রসারে?
উত্তর: সুফিরা শান্তিপূর্ণ দাওয়াত, মানবিকতা ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করেন। শাহ জালাল (রহ.), খানজাহান আলী (রহ.), সৈয়দ নাসিরুদ্দিন (রহ.) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
🟢 প্রশ্ন ৬: আরব বণিকরা কেন বাংলাদেশে আসতেন?
উত্তর: আরব বণিকরা চীন, ভারত ও আরবের মধ্যে বাণিজ্যের লক্ষ্যে বাংলাদেশ অঞ্চলে আসতেন। সিলেট ও চট্টগ্রাম ছিল তাদের গুরুত্বপূর্ণ যাত্রাবিরতির বন্দর। বাণিজ্যের পাশাপাশি তারা ইসলাম প্রচারেও সক্রিয় ছিলেন।
🟢 প্রশ্ন ৭: ইসলামের আগমন বাংলাদেশে কী প্রভাব ফেলেছিল?
উত্তর: ইসলাম আগমনের ফলে সমাজে নতুন নৈতিকতা, শিক্ষা, বিচারব্যবস্থা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রবেশ ঘটে। মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকা গড়ে ওঠে এবং মুসলিম সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পায়।
মন্তব্য করুন
Your email address will not be published.