
ফিলিস্তিনের ইতিহাস ও ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা
ফিলিস্তিন শুধু একটি ভূখণ্ড নয়—এটি ইতিহাস, ধর্ম ও রাজনীতির মিলনস্থল। হাজার বছরের পুরনো এই অঞ্চলের ইতিহাসে রয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ শাসন, সংঘর্ষ এবং এক অব্যাহত সংগ্রামের গল্প। চলুন জেনে নিই ফিলিস্তিনের প্রকৃত ইতিহাস, যেটি আজও পুরো বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়।
ফিলিস্তিনের ইতিহাস

ফিলিস্তিন নামটি প্রাচীনকাল থেকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক অঞ্চলের নাম হিসেবে পরিচিত। ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত এই অঞ্চলটি বর্তমান ইসরায়েল, পশ্চিম তীর (West Bank), গাজা উপত্যকা (Gaza Strip) ও আশেপাশের কিছু অংশকে অন্তর্ভুক্ত করে। ফিলিস্তিন অঞ্চলের ইতিহাস হাজার হাজার বছর পুরনো, এবং এটি তিনটি প্রধান ধর্ম—ইসলাম, খ্রিস্টধর্ম ও ইহুদধর্মের জন্য পবিত্র স্থান।
প্রাচীনকালে, এই অঞ্চলটি কনানীয় (Canaanite) জাতির অধীনে ছিল। পরে মিশরীয়, অ্যাসিরীয়, ব্যাবিলনীয়, পার্সিয়ান, গ্রিক এবং রোমান সাম্রাজ্যের অধীন হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১২ শতকে প্যালেস্টাইন উপকূলে ‘ফিলিস্তীয়’ (Philistines) জাতির বসতি স্থাপন ঘটে, যাদের নাম থেকেই ফিলিস্তিন (Palestine) নামটি এসেছে বলে ধারণা করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে এখানে ইহুদিদের ‘দাউদ’ ও ‘সোলায়মান’ (আলাইহিমুস সালাম) এর শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, যার রাজধানী ছিল বাইতুল মুকাদ্দাস (Jerusalem)। তবে এই শাসন স্থায়ী হয়নি।
রোমানরা ৭০ খ্রিস্টাব্দে বাইতুল মুকাদ্দাস ধ্বংস করে ইহুদিদের বিতাড়িত করে এবং অঞ্চলটিকে ‘Palaestina’ নাম দেয়। এরপর ইসলামি শাসনের সূচনা ঘটে ৭ম শতাব্দীতে, যখন খলিফা উমর (রা.) ৬৩৮ সালে ফিলিস্তিন জয় করেন। ইসলামী খেলাফতের অধীনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হয়ে ওঠে। বাইতুল মুকাদ্দাসে ‘আল-আকসা মসজিদ’ মুসলমানদের প্রথম কিবলা ও তৃতীয় পবিত্র মসজিদ হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব পায়।
১১শ শতকে খ্রিস্টানদের ক্রুসেড অভিযান শুরু হয়, যার ফলে কিছু সময়ের জন্য ফিলিস্তিন খ্রিস্টানদের দখলে চলে যায়। কিন্তু বিখ্যাত মুসলিম সেনাপতি সালাহউদ্দিন আইয়্যুবী ১১৮৭ সালে ক্রুসেডারদের পরাজিত করে আল-আকসা পুনরুদ্ধার করেন। এরপর মমলুক, উসমানীয় (Ottoman) সাম্রাজ্যের অধীনে এই অঞ্চল দীর্ঘ সময় (১৫১৭-১৯১৭) ছিল।
১৯১৭ সালে ব্রিটিশদের ‘বেলফোর ঘোষণা’র মাধ্যমে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনকে তাদের ‘ম্যান্ডেট’ হিসাবে শাসন করে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুটি ভাগে—ইহুদি ও আরব রাষ্ট্রে ভাগ করার পরিকল্পনা দেয়, যদিও আরব দেশগুলো এতে সম্মত হয়নি। এর পরেই ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হয়, যার ফলে প্রায় ৭ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে—এই ঘটনাকে “নাকবা” (বিপর্যয়) বলা হয়।
এরপর থেকে শুরু হয় ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব। ইসরায়েল পশ্চিম তীর, গাজা এবং জেরুজালেম দখল করে নেয়। ফিলিস্তিনিরা তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছে। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল পুরো পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা দখল করে। ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা (PLO) প্রতিষ্ঠিত হয় ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকার আন্দোলনের অংশ হিসেবে। ১৯৮৭ ও ২০০০ সালে ফিলিস্তিনে দুটি ‘ইন্তিফাদা’ (জনঅভ্যুত্থান) ঘটে, যার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি দখলদারত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।
বর্তমানে, ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের কিছু অংশ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ দ্বারা পরিচালিত হলেও ইসরায়েল সেখানে অবৈধ বসতি গড়ছে। গাজা অঞ্চলে ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস ক্ষমতায় রয়েছে, যাদের সাথে ইসরায়েলের প্রায়শই সংঘর্ষ ঘটে। জাতিসংঘ ২০১২ সালে ফিলিস্তিনকে "non-member observer state" স্বীকৃতি দিলেও এখনো পূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নির্যাতিত, নিপীড়িত এই জাতি এখনও তাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
ফিলিস্তিন শুধুমাত্র একটি ভৌগোলিক স্থান নয়—এটি একটি পবিত্র ভূমি, যার প্রতিটি ধূলিকণায় ইতিহাস, নবী ও মানবতার শিক্ষা মিশে আছে। এই অঞ্চলের সাথে জড়িত আছেন বহু নবী, বিশেষত দাউদ (আ.) ও সোলায়মান (আ.)। ফিলিস্তিনের ইতিহাসকে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেন সত্যকে বিকৃত না করা হয় এবং মুসলিম উম্মাহ সঠিক উপলব্ধি অর্জন করে।
ফিলিস্তিনের ইতিহাস প্রাচীন ও কনানীয় সভ্যতা
ফিলিস্তিন অঞ্চলের ইতিহাস প্রায় ৫ হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীনকালে এটি কনানীয় (Canaanite) জাতির অধীনে ছিল, যাদের সভ্যতা ছিল উন্নত ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ। এরপর বিভিন্ন জাতি ও সাম্রাজ্য এই অঞ্চলে আগমন করে, যার মধ্যে মিশরীয়, অ্যাসিরীয় ও ব্যাবিলনীয়রা ছিল উল্লেখযোগ্য।
নবী দাউদ (আ.) ও সোলায়মান (আ.)-এর শাসন: ইনসাফভিত্তিক ইসলামি শাসনব্যবস্থা
খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে আল্লাহর প্রেরিত নবী দাউদ (আ.) ফিলিস্তিন অঞ্চলে আল্লাহর পক্ষ থেকে রাজত্ব লাভ করেন এবং বাইতুল মুকাদ্দাসকে কেন্দ্র করে একটি তাওহিদভিত্তিক ন্যায়বিচারপূর্ণ ইসলামি শাসন কায়েম করেন।
আল্লাহ বলেন:
“হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে খলীফা করেছি; সুতরাং তুমি মানুষের মধ্যে ন্যায়ের সাথে বিচার কর।”
— (সূরা ছাদ: ২৬)
এরপর তাঁর পুত্র নবী সোলায়মান (আ.) তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি অসাধারণ ক্ষমতা ও জ্ঞান দ্বারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী রাজত্ব পরিচালনা করেন। তাঁদের শাসন কোনো জাতীয়তাবাদ নয়; বরং ছিল আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার একটি মডেল।
ফিলিস্তিনে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আগমন
হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আগমন ফিলিস্তিনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। নূহ (আ.)-এর যুগে প্লাবনে সমগ্র মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর তিনিই সর্বপ্রথম তাওহিদের (একত্ববাদের) বাণী নতুন করে প্রচার শুরু করেন। তাঁর আগমনের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনের ভূমিতে আবারও তাওহিদের আলো প্রজ্বলিত হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ১৯ শতকে হজরত ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর স্ত্রী হজরত সারা (আ.) ইরাক থেকে হিজরত করে ফিলিস্তিনে আগমন করেন। তাঁরা জেরুজালেমে একটি উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে ‘বাইতুল মাকদিস’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। এই পবিত্র স্থানটিই পরবর্তীতে ইসলাম, খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মের কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান হিসেবে স্বীকৃত হয়। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর পুত্র ইসহাক (আ.) ও তাঁর বংশধররাও এই পবিত্র ভূমির পরিচর্যা ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
ফিলিস্তিনে বনি ইসরাইলের আবির্ভাব
হজরত ইসহাক (আ.)-এর পুত্র হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর জন্ম ফিলিস্তিনে হয়। পরে কিছু সময় তিনি তুরস্কে (সম্ভবত সিরিয়ার উত্তরের অংশে) হিজরত করেন। কিন্তু অল্প সময় পর তিনি পুনরায় ফিলিস্তিনে ফিরে আসেন। হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর আরেক নাম ছিল ‘ইসরাইল’, এবং তাঁর বংশধরদের বলা হয় বনি ইসরাইল।
ফিলিস্তিনের সে সময়কার শাসক ছিল হেকসোসরা। পরবর্তীতে মিসরের সম্রাট আহমোস ফিলিস্তিন আক্রমণ করে হেকসোসদের পরাজিত করেন। কিন্তু বনি ইসরাইলদের হেকসোসদের সহযোগী মনে করে তিনি তাদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন শুরু করেন। এই দমন-পীড়ন চলে প্রায় তিন শত বছর পর্যন্ত।
এই দীর্ঘকালীন অত্যাচার ও দাসত্বের ফলে বনি ইসরাইলদের ধর্মীয় ও নৈতিক অবক্ষয় ঘটে। তারা এক সময় মূর্তিপূজার মতো শিরকে জড়িয়ে পড়ে। অথচ তারা ছিল মূলত এক সময়কার নৈতিকতাসম্পন্ন, ধর্মভীরু ও ঐশী বার্তার ধারক এক সম্প্রদায়। দাসত্ব ও দমননীতির কারণে তাদের প্রকৃত চরিত্রে নেমে আসে অবক্ষয়, যা তাদের ভবিষ্যৎ ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলে।
হজরত ইউশা (আ.)-এর নেতৃত্বে ফিলিস্তিন বিজয়
হজরত মুসা (আ.)-এর ইন্তেকালের পর বনি ইসরাইলের নেতৃত্ব পান হজরত ইউশা (আ.)। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সালে বনি ইসরাইলদের নিয়ে ফিলিস্তিনে প্রবেশ করেন। সেখানে কেনআনিদের সঙ্গে এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়, যেখানে বনি ইসরাইল বিজয়ী হয় এবং ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন করে।
তবে শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তাঁর জীবদ্দশাতেই বনি ইসরাইলদের মাঝে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। তাঁরা আবারও পৌত্তলিকতায় জড়িয়ে পড়ে এবং হজরত মুসা (আ.)-এর লাঠি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। তাদের চরম অবাধ্যতা আল্লাহর গজবকে আহ্বান করে।
ফিলিস্তিনে হজরত দাউদ (আ.)-এর শাসন ও জালুত হত্যাকাণ্ড
খ্রিস্টপূর্ব একাদশ শতাব্দীর শেষদিকে বনি ইসরাইলের নেতৃত্বে আসেন তালুত (শাওল ইবনে কায়স)। সে সময় ফিলিস্তিনিদের শক্তিশালী সেনাপতি ছিলেন জালুত, যার নেতৃত্বে এক বিশাল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে তরুণ হজরত দাউদ (আ.) সাহসিকতার সঙ্গে জালুতকে হত্যা করেন, এবং পরে তিনিই বনি ইসরাইলের নতুন নেতা হন।
হজরত দাউদ (আ.) ফিলিস্তিনে সবচেয়ে বড় ঈমানদার রাষ্ট্র গঠন করেন। এটিই ছিল ফিলিস্তিনে সর্বপ্রথম এমন এক শাসন যেখানে সত্য, ইনসাফ ও তাওহিদের ভিত্তিতে সমাজ পরিচালিত হয়।
হজরত সুলায়মান (আ.) ও ফিলিস্তিনের স্বর্ণযুগ
হজরত দাউদ (আ.)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর পুত্র সুলায়মান (আ.) বনি ইসরাইলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন নবী ও বাদশাহ, যিনি জ্বিন, মানুষ ও পশুপাখিদেরও শাসন করতেন। তাঁর শাসনকাল ছিল দাপটপূর্ণ ও সুব্যবস্থাপনায় ভরপুর।
হজরত সুলায়মান (আ.) জিনদের দ্বারা বাইতুল মাকদিস সংস্কার ও উন্নয়ন করান। তবে তাঁর ইন্তেকালের পরে বনি ইসরাইল ১২টি গোত্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে—১০টি গোত্র ফিলিস্তিনের উত্তর অংশে এবং ২টি গোত্র দক্ষিণ অংশে রাজত্ব করতে থাকে। এই বিভাজন ও আত্মকলহ তাদের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বনি ইসরাইলের রাজত্বের পতন
বিভক্ত ও দুর্বল বনি ইসরাইল সাম্রাজ্য একপর্যায়ে বাইরের শত্রুদের কবলে পড়ে। খ্রিস্টপূর্ব ৯২০ সালে মিশরের সম্রাট শিশাংক উত্তরাঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে তা দখল করে নেয়। এরপর খ্রিস্টপূর্ব ৭২১ সালে আসিরিয়ানরা দক্ষিণাঞ্চলে হামলা চালিয়ে দখল করে নেয়। ফলে ধ্বংস হয়ে যায় প্রায় ২০০ বছরের ইসরাইলি শাসন।
ইসলামী খেলাফত থেকে ক্রুসেড যুদ্ধ পর্যন্ত
৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.) ফিলিস্তিন জয় করেন। এর মাধ্যমে বাইতুল মুকাদ্দাস শান্তিপূর্ণভাবে মুসলিম শাসনে আসে। এরপর উমাইয়া, আব্বাসিয়া ও উসমানীয় খেলাফতের অধীনে এই অঞ্চল শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ছিল।
১১শ শতকে খ্রিস্টানদের ক্রুসেড আক্রমণে কিছু সময়ের জন্য বাইতুল মুকাদ্দাস হারিয়ে যায়, তবে সালাহউদ্দিন আইয়্যুবী (রহ.) ১১৮৭ সালে তা পুনরুদ্ধার করে ইসলামের মর্যাদা রক্ষা করেন।
ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ও ইহুদি অভিবাসনের শুরু
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯১৭ সালে ব্রিটেন 'বেলফোর ঘোষণা' দেয়, যেখানে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের সমর্থন জানানো হয়। এটি ছিল একটি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, যাতে ব্রিটেন ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তি ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করে।
এরপর ১৯৪৮ সালে "ইসরায়েল রাষ্ট্র" ঘোষণা করা হয়, যার ফলে প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি নিজেদের জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়। এই ঘটনা ইতিহাসে “নাকবা” (বিপর্যয়) নামে পরিচিত।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধ ও অবৈধ দখল
১৯৬৭ সালে ইসরায়েল গাজা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। এরপর শুরু হয় ইহুদি বসতি নির্মাণ, যা আজও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে অব্যাহত আছে।
ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম: ইন্তিফাদা থেকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
১৯৮৭ ও ২০০০ সালে দুটি 'ইন্তিফাদা' (জন-আন্দোলন) শুরু হয়, যেখানে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
২০১২ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে “Non-member observer state” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা একটি বড় কূটনৈতিক অর্জন।
বিস্তারিত পড়ুনঃ
ফিলিস্তিনের বর্তমান অবস্থা ২০২৫
মুসলমানদের উচ্ছেদ ও ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা
মুসলমানদের উচ্ছেদ শুরু
১৯২০ সালের পর বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ব্রিটিশরা ম্যান্ডেটরি প্যালেস্টাইন প্রতিষ্ঠা করে।
ফিলিস্তিনিরা স্বাধীন রাষ্ট্রের আশা করলেও, ব্রিটিশরা ধোঁকা দিয়ে ইহুদিদের বসতি স্থাপনের সুযোগ করে দেয়।
হাগানাহ, ইরগুন ও স্টার্ন গ্যাং নামক ইহুদিবাদী সংগঠনগুলো ব্রিটিশ বাহিনীর সহায়তায় ফিলিস্তিনি মুসলিমদের ওপর গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজ চালায়।
আরবদের ফিলিস্তিন ছাড়তে বাধ্য করতে এসব হামলা করা হয়।
১৯৪০ ও ১৯৪২ সালে ইহুদি বোঝাই দু'টি জাহাজ হাইফা বন্দরে ধ্বংস করে নিজেরাই, যাতে বিশ্বমতের সহানুভূতি পাওয়া যায়।
জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনা (১৯৪৭)
১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘে ভোট গ্রহণ হয়।
ফলাফল: ৩৩টি দেশ ইহুদি রাষ্ট্রের পক্ষে, ১৩টি বিপক্ষে, ১০টি নিরপেক্ষ।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ইহুদিরা পায় ৫৭% জমি, আরবরা ৪৩%।
তবে ইহুদিদের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অনির্ধারিত ছিল, যা ভবিষ্যৎ দখলের পথ তৈরি করে।
ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা ১৯৪৮ সাল
১৯৪৮ সালের ১২ মে রাত ১২:০১ মিনিটে ইহুদি নেতা দাভিদ বেন গুরিয়ন ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন।
মাত্র ৯ মিনিট পরই যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেনও স্বীকৃতি দেয়।
শুরু হয় ব্যাপক মুসলিম উচ্ছেদ, দখল, হত্যা ও দুর্ভোগ।
বহু ফিলিস্তিনি লেবানন, মিশর প্রভৃতি দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
হামাসের প্রতিষ্ঠা ১৯৮৭ সাল
মিশরে শরণার্থী থাকা বহু ফিলিস্তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের আদর্শে প্রভাবিত হন।
সেই আদর্শ থেকেই ১৯৮৭ সালে আহমেদ ইয়াসিন ও আব্দেল আজিজ আল-রানতিসি প্রতিষ্ঠা করেন হামাস (Harakat al-Muqawama al-Islamiyya)।
হামাসের দুটি শাখা:
দাওয়াহ (Dawah) – সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দাওয়াতি কাজের জন্য
ইজ্জ আদ-দ্বীন আল-কাসসাম ব্রিগেডস – সশস্ত্র প্রতিরোধের জন্য
আজকের ফিলিস্তিন: রক্তাক্ত বাস্তবতা
আজ ফিলিস্তিন মূলত দুই ভাগে বিভক্ত—গাজা ও পশ্চিম তীর। গাজায় হামাস এবং পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (PA) কার্যক্রম চালায়।
ইসরায়েলি অবরোধ, বিমান হামলা ও বসতি নির্মাণ আজও চলমান রয়েছে। বিশ্বের বহু মুসলিম রাষ্ট্র নীরব, আর ফিলিস্তিনিরা প্রতিদিন জীবন দিয়ে ইতিহাস লিখছে।
ফিলিস্তিনের ইতিহাস হলো একটি সত্যের ইতিহাস, এক ন্যায়বিচারের আন্দোলন। এখানে কোনো “ইহুদি রাজত্ব” ছিল না, বরং ছিল নবীদের দ্বারা পরিচালিত তাওহিদভিত্তিক ইনসাফপূর্ণ শাসনব্যবস্থা।
আজ এই ভূমি আবারও অধিকার ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায়, যেখানে শান্তি ফিরবে ইনসাফ ও হক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
প্রাসঙ্গিক প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১: নবী দাউদ (আ.) কি ইহুদি রাষ্ট্র গড়েছিলেন?
উত্তর: না, তিনি আল্লাহর নবী ছিলেন এবং তাওহিদভিত্তিক ইসলামি শাসন পরিচালনা করেছিলেন।
প্রশ্ন ২: আল-আকসা মসজিদের গুরুত্ব কী?
উত্তর: এটি মুসলিমদের প্রথম কিবলা ও তৃতীয় পবিত্র মসজিদ। এখান থেকেই রাসূল (সা.) মেরাজে গমন করেন।
প্রশ্ন ৩: ফিলিস্তিন কখন ব্রিটিশ দখলে যায়?
উত্তর: ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণার পর থেকে, আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯২০ সাল থেকে।
প্রশ্ন ৪: ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দিয়েছে কি?
উত্তর: ২০১২ সালে “Non-member observer state” হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
প্রশ্ন ৫: ফিলিস্তিনের ইতিহাস কত বছরের পুরনো?
উত্তর: প্রায় ৫ হাজার বছরের পুরনো, কনানীয় সভ্যতা থেকে এর শুরু।
প্রশ্ন ৬: আল-আকসা মসজিদের গুরুত্ব কী?
উত্তর: এটি মুসলিমদের প্রথম কিবলা ও তৃতীয় পবিত্র মসজিদ।
প্রশ্ন ৭: ইসরায়েল রাষ্ট্র কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর: ১৪ মে, ১৯৪৮ সালে।
প্রশ্ন ৮: ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কি জাতিসংঘে স্বীকৃত?
উত্তর: হ্যাঁ, ২০১২ সালে non-member observer state হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
মন্তব্য করুন
Your email address will not be published.