india muslim nirjaton (1)_1750881495.jpg

ভারতে মুসলিম নির্যাতন চিত্র ২০২৫

ভারতে মুসলিমদের ওপর নির্যাতন একটি সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার বিষয়, যা গত কয়েক বছরে ঘন ঘন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা ও সমাজকর্মীদের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। এখানে আমরা ভারতে মুসলিম নির্যাতনের পটভূমি, প্রকারভেদ, কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং এর সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব বাস্তব ও ভারসাম্যপূর্ণভাবে তুলে ধরবো।

 

ভারতে মুসলিম নির্যাতন: বাস্তব প্রেক্ষাপট

🔰 ধর্মীয় বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি

ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও, কিছু রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় বিভাজনমূলক রাজনীতি করে আসছে। মুসলিমদের "অন্য ধর্মের", "বিদেশি" বা "আক্রমণকারী" হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা ভারতীয় জনসংখ্যার একাংশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে।

🛑 মুসলিম নির্যাতনের ধরনসমূহ:

১. 🤬 ঘৃণামূলক বক্তব্য ও হেইট ক্যাম্পেইন

টিভি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও নির্বাচনী মঞ্চে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হেট স্পিচ বেড়ে গেছে। কিছু উগ্র সংগঠন মুসলিমদের ধর্মীয় রীতি-নীতি, পোশাক, খাবার ইত্যাদি নিয়ে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে।

২. 🔥 দাঙ্গা ও সহিংসতা

দিল্লি (২০২০) সহ একাধিক স্থানে মুসলিম বিরোধী দাঙ্গায় বহু মুসলমান প্রাণ হারিয়েছেন, ঘরবাড়ি হারিয়েছেন, নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এইসব দাঙ্গার সময় পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকার অভিযোগও এসেছে।

৩. 🕌 ধর্মীয় অধিকার হরণ

মুসলিমদের নামাজ আদায়, আজান দেওয়া, মসজিদ রক্ষা ইত্যাদি বিষয়েও বিভিন্ন স্থানে বাধা দেওয়া হয়েছে। বুলডোজার অভিযান চালিয়ে মুসলিমদের বাড়িঘর ও দোকান ভাঙা হয়েছে ‘অবৈধ নির্মাণ’ অজুহাতে।

৪. 📜 আইন ও প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব

CAA (Citizenship Amendment Act) ও NRC (National Register of Citizens) আইন মুসলিমদের নাগরিকত্ব নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। অনেক মুসলিম পরিবার নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

৫. 🧕 মুসলিম নারীদের টার্গেটিং

হিজাব নিষিদ্ধকরণ (কর্ণাটকে) ও মুসলিম নারীদের অনলাইনে "নিলামে তোলা" (Sulli Deals, Bulli Bai অ্যাপ কেলেঙ্কারি) অত্যন্ত লজ্জাজনক ও বিদ্বেষমূলক ঘটনা ছিল।

🧭 আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বহু সংস্থা ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে নিপীড়নের প্রতিবাদ জানিয়েছে।

ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়, এটি অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

📉 প্রভাব:

সমাজে বিভক্তি বাড়ছে, ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে।

মুসলিম যুবকদের মধ্যে হতাশা, নিরাপত্তাহীনতা ও বিচ্ছিন্নতার অনুভব তৈরি হচ্ছে।

অনেক মুসলিম পরিবার শিক্ষা, চাকরি ও বাসস্থানের ক্ষেত্রে বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছে।

 

ভারতের মুসলিমদের নির্যাতনের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা

 

 

ভারতে ভাঙা হল ১৮৫ বছরের পুরোনো নূরী মসজিদের একাংশ

ভারতের উত্তর প্রদেশের (ইউপি) ফতেহপুর জেলার ১৮৫ বছরের পুরনো নূরী জামে মসজিদের একাংশ ভেঙে ফেলেছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের দাবি, মসজিদের এই অংশটি বান্দা-বাহরাইচ হাইওয়ের অংশে অবৈধভাবে করা হয়েছিল।

জেলা প্রশাসনের দাবি, মসজিদের ভেঙে ফেলা অংশটি বেআইনি ছিল। তাদের দাবি, ভাঙা অংশটি গত দুই-তিন বছরে নির্মিত হয়েছিল এবং এটি অবৈধ। স্যাটেলাইট ও ঐতিহাসিক চিত্রের ভিত্তিতে এই দাবি করা হয়েছে। পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট (পিডব্লিউডি) দাবি করেছে, তারা গত ১৭ আগস্ট তাদের “অবৈধ নির্মাণের”কারণে মসজিদের কিছু অংশ সরানোর নোটিশ দিয়েছিল। তাই নির্ধারিত সময়ের পর গণপূর্ত বিভাগ থেকে মসজিদটির ওই অংশ ভেঙে ফেলা হয়।

মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে এ বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য এলাহাবাদ হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়। আদালত থেকে এই বিষয়ে কোনও আদেশ আসার আগেই এই পদক্ষেপ নিয়েছে জেলা প্রশাসন

ভারতে মুসলমানদের ধর্মীয় ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোতে নানা কারণে দেশটির নাগরিক এবং প্রশাসনের হস্তক্ষেপে চালানো অবদমনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। সুত্র

ভারতে ১৬ দিনেই মুসলিমদের উপর ১৮৪ হামলা

বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতেই সবচেয়ে বেশি মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণাভাষণ, হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা সামনে এসেছে।

জম্মু ও কাশ্মিরের পেহেলগামে হামলার পর থেকে দেশজুড়ে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর বেড়েছে সহিংসতা, আক্রমণ, হামলা ও নির্যাতন। চলতি বছরের ২২ এপ্রিল থেকে ৮ মে পর্যন্ত মুসলিমদের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ১৮৪টি বিদ্বেষমূলক ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে শুধু পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে ১০৬টি সহিংসতা, আক্রমণ, হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।

বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতেই সবচেয়ে বেশি মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণাভাষণ, হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা সামনে এসেছে। ঘৃণা ভাষণের ফলে কমপক্ষে ৩১৬ জন মুসলিম ব্যক্তিকে শারীরিক নিগৃহ ও নির্যাতন করা হয়েছে বলে রিপোর্টে উঠে এসেছে।

 

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ওয়াকফের জমিতে নির্মিত শতাব্দী প্রাচীন তাকিয়া মসজিদ বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেয় ভারত সরকার

চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভারতের মধ্য প্রদেশের উজ্জয়িনী শহরে বাড়িঘর, দোকান এবং একটি শতাব্দী প্রাচীন মসজিদসহ প্রায় ২৫০টি অবকাঠামো বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। এর মাধ্যমে উজাড় করা হয় ২.১ হেক্টর (৫.২৭ একর) বিস্তৃত জমি। 

 

জমিটি মধ্যপ্রদেশ ওয়াকফ বোর্ডের ছিল। আরবি ভাষা থেকে উদ্ভূত, ‘ওয়াকফ’ বলতে স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি বোঝায় - মসজিদ, স্কুল, কবরস্থান, এতিমখানা, হাসপাতাল এমনকি খালি জমি - যা ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে দান করেন মুসলিমরা। যার ফলে এ ধরনের সম্পত্তি হস্তান্তর অপরিবর্তনীয় এবং বিক্রয় ও অন্যান্য ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।

 

ভারতের উত্তরপ্রদেশে মুসলিম নির্যাতন : মারধর করে 'জয় শ্রীরাম' বলানো, হেনস্থার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে দেওয়া যেখানে এখন রুটিন

ভোটের আগে রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকেই খবর আসছে, পরিকল্পিতভাবে মুসলিমদের ওপর সেখানে হামলা চালানো হচ্ছে এবং মারধর করে তাদের 'জয় শ্রীরাম' বলতেও বাধ্য করা হচ্ছে।

 

মন্দিরে জল খেতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার

সেখানকার একটি হিন্দু মন্দিরে ঢুকে জল খাওয়ার অপরাধে বারো-তেরো বছরের একটি ছেলেকে মাটিতে ফেলে নৃশংসভাবে মারধর করছিল দু‌'তিনজন যুবক।

বাচ্চা ছেলেটির নাম আসিফ, বাবার নাম হাবিব - এটা শোনার পর বেধড়ক মারের পাশে চলতে থাকে অকথ্য গালিগালাজ।

 

ভারতে মুসলিম নির্যাতনের আরো কিছু ঘটনাঃ

১. অসম ও বিভিন্ন রাজ্যে নাগরিকত্বহীন হিসেবে অবৈধ মুসলিম নাগরিকদের ভারত থেকে বের করে দেওয়া

২০২৫ সালের জুনে, মানবাধিকার সংস্থাগুলো অভিযোগ করেছে যে, বহু মুসলিম—যাদের মধ্যে নাগরিকত্বপত্র ছিল—তাদের রাজ্য থেকে ডিটেইন করে, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (BSF) দিয়ে গুলি দেখিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে shiawaves.com। বিশেষ করে আসামে চালানো “Operation Sindhoor” এ এই অবৈধ কার্যক্রম বাড়ছে এবং বহু পরিবার দখল হয়ে পড়ছে।

২. ওয়াকফ (Waqf) আইনে পরিবর্তনের প্রতিবাদে সংঘর্ষ

এপ্রিল ২০২৫-এ “Waqf (Amendment) Act, 2025” পাশের পর পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ ও সংঘর্ষ শুরু হয়। ৮–১৩ এপ্রিল পর্যন্ত ওই এলাকায় বেশ কয়েকজন নিহত ও কয়েকশ’ গ্রেপ্তার হয়েছে; হাই কোর্ট অবিলম্বে কেন্দ্রীয় ফোর্স মোতায়েন করে theguardian.comsouthasiajusticecampaign.org+2en.wikipedia.org+2en.wikipedia.org+2

৩. নাগপুরে ধর্মীয় দাঙ্গা (Nagpur Violence)

১৭ মার্চ ২০২৫-এ মহারাষ্ট্রের নাগপুরে একটি হিন্দু গোষ্ঠী প্রাচীন সম্রাট আওরঙ্গজেবের মাজার অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ দেখে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ দাঙ্গা-রূপ নেয় এবং এক মুসলিম নাগরিক নিহত হয়, ৩০+ আহত এবং ১০০+ গ্রেপ্তার হয় ।

৪. তেলেঙ্গানার ভাইনসে মুসলিম সরকারি কর্মচারীকে আক্রমণ

১৮ মার্চ ২০২৫-এ ভাইনসে (Bhainsa, Telangana) একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে আব্দুল ওয়াকিল নামের মুসলমান সরকারি কর্মচারীকে বিশুদ্ধ হিন্দুত্ববাদী ‘হিন্দু বাহিনী’ সদস্যরা সাফরন কাপড়ে ফাইল বহনের কারণে মারধর করছে। পুলিশ কোনো মামলা দায়ের না করলে চারজনকে গ্রেপ্তার করে kmsnews.org

৫. দিল্লির উত্তর ঘটান্দায় “জয় শ্রী রাম” না বলায় মুসলিম পরিবারদের চাপে ফেলা

১৮ মার্চ ২০২৫-এ উত্তর ঘুন্ডায় (North Ghonda, New Delhi) এক মুসলিম পরিবারের সদস্যদের “জয় শ্রী রাম” না বলায় হুমকি দেওয়া হয়। তাঁদের জানানো হয়, না বললে তাদের বাসা বিক্রি করে দিতে হবে। কিছু প্রতিবেশী প্রতিবাদও করে kmsnews.org

৬. কুইম্বাটুরে চার মুসলিম যুবককে NIA ধরে নেওয়া

২৪ জুন ২০২৫-এ তামিলনাড়ুর কুইম্বাটুরে চার মুসলিম যুবককে NIA (National Investigation Agency) গ্রেপ্তার করে—তাদের উপর আইএস ও র‌্যাডিক্যালাইজেশনের অভিযোগ আনা হয়েছে। স্থানীয় মুসলিম সংগঠনগুলো এই গ্রেপ্তারগুলোকে নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে টার্গেটিং হিসেবে দেখে ।

৭. পূঃবঙ্গের ওয়াকফ আইনের ঘটনায় তিন জন নিহত

পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে ওয়াকফ সংশোধন বিলের প্রতিবাদে সংঘর্ষে তিন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে ।

৮. কানপুর, বেটুল, দেবগড়ে হত্যাকাণ্ড ও হিংসা

এপ্রিলের রিপোর্ট অনুযায়ী—কানপুরে ষাঁড় বিরোধে এক ১৩ বছর বয়সী মুসলিম ছেলেকে ছুরিকাঘাত করা হয়, বেটুল, মধ্যপ্রদেশে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে, দেবগড় (রাজস্থান) এলাকায় রামনবমির সময় হিংসা ছড়িয়ে পড়ে ।

 

২০২৫ সালে ভারত জুড়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে নানারকম হিংসা, বৈষম্য, সংস্কৃতি-ধর্মের জন্য হামলা ও প্রশাসনিকভাবে ঘটেছে। Waqf বিল ও নাগরিকত্ব ইস্যুতে ভাঙন বাড়ছে এবং আরও সহিংসতা ও বিতাড়ন ঘটছে। মানুষ-সম্প্রদায় হিসেবে অতি সমালোচনার মধ্যেই মুসলিমদের পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা এখন গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

উপসংহার:
ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমানাধিকারের কথা বলে, কিন্তু বাস্তবতায় মুসলিম সম্প্রদায় বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে—এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় সরকার, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া এবং আন্তর্জাতিক মহলের কার্যকর ভূমিকা এখন সময়ের দাবি।