israel-filistin war_1751456734.jpg

ইসরাইল ফিলিস্তিন যুদ্ধের মূল কারণগুলো কী? ইতিহাস, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটসহ

ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের মূল শিকড় নিহিত রয়েছে ১৯৪০-এর দশকের মধ্যভাগে, বিশেষ করে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়কালকে ঘিরে। তখন ব্রিটিশ অধিকৃত প্যালেস্টাইন ভূমিতে জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী একাংশে ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করা হয়, যেটিকে ফিলিস্তিনিরা অবৈধ ও অন্যায় দখল হিসেবে দেখে। এই সময় প্রায় সাত লক্ষ ফিলিস্তিনি মুসলমান তাদের নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হন—যাকে বলা হয় "নাকবা" বা বিপর্যয়। এরপর ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেম, গাজা, পশ্চিম তীর দখল করে নেয়, যেটা জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিকভাবে এখনও "অবৈধ দখল" হিসেবে স্বীকৃত।

মূলত ফিলিস্তিনিরা নিজেদের রাষ্ট্র, স্বাধীনতা ও জমির অধিকার ফিরে পেতে চায়, আর ইসরায়েল চায় পূর্ণ নিরাপত্তা ও ভূখণ্ডীয় দখল বজায় রাখতে। এরই মাঝে ইহুদি বসতি স্থাপন, মুসলিমদের পবিত্র স্থান আল-আকসা মসজিদে আগ্রাসন, সামরিক অভিযান, অবরোধ, এবং হামাস ও ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি আক্রমণ যুদ্ধকে আরও জটিল করে তুলেছে। ধর্মীয় দ্বন্দ্ব, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ, আন্তর্জাতিক শক্তির পক্ষপাতিত্ব, এবং উপনিবেশিক ইতিহাস এই সংকটকে দীর্ঘায়িত ও ভয়াবহ করে তুলেছে।

 

১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধ: ইতিহাস, প্রেক্ষাপট ও ফলাফল

১৯৪৮ সালের ১৪ মে, ইহুদি নেতৃত্বাধীন প্রশাসন ফিলিস্তিনের একাংশে "ইসরায়েল রাষ্ট্র" প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণা ঐ অঞ্চলের আরব মুসলিম জনগণের জন্য ছিল এক বিপর্যয়। ফলে, ফিলিস্তিনের আরবদের পক্ষ নিয়ে আরব লীগ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা তাদের বাহিনী ব্রিটিশ অধিকৃত সাবেক প্যালেস্টাইন অঞ্চলে প্রবেশ করায়, এবং শুরু হয় ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধ — ইতিহাসে যেটি "প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ" নামে পরিচিত।

এই যুদ্ধ ছিল একপাক্ষিকভাবে রক্তক্ষয়ী এবং রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় ১৫,০০০ জন হতাহত হন। যুদ্ধের শেষে, ১৯৪৯ সালে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে:

  • ইসরায়েল প্রাক্তন ব্রিটিশ ম্যান্ডেট অঞ্চলের বেশিরভাগ অংশ দখল করে ফেলে।
  • জর্ডান দখল করে পশ্চিম তীর
  • মিশর নিয়ন্ত্রণ নেয় গাজা উপত্যকার উপর।
  • এ সময় আরব লীগ গাজায় একটি প্রতীকী “সর্ব-প্যালেস্টাইন সরকার” ঘোষণাও করে, যা বাস্তবে কোনো ক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি।

এই যুদ্ধ এবং তার পূর্ববর্তী ১৯৪৭-৪৮ সালের গৃহযুদ্ধ ছিল ফিলিস্তিনিদের জন্য এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডি। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রায় ৭,৫০,০০০ ফিলিস্তিনি মুসলমান ও খ্রিস্টান নাগরিক নিজেদের ভূমি, ঘরবাড়ি ও শেকড় থেকে উচ্ছেদ হন। এই ঘটনা “নাকবা (النكبة)” নামে পরিচিত — যার অর্থ "বিপর্যয়"। বহু গ্রাম ধ্বংস করা হয়, এবং ফিলিস্তিনিরা আশ্রয় নেয় জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া ও গাজা অঞ্চলে উদ্বাস্তু হিসেবে।

ইসরায়েলের প্রত্যাবর্তন আইন (Law of Return, 1950)

১৯৫০ সালে, ইসরায়েল “Law of Return” নামের একটি আইন পাস করে, যার মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো ইহুদি নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার পায়, এমনকি তারা যদি কখনো ইসরায়েলে বসবাস না করেও থাকে। এই আইন অনুযায়ী, তাদের স্ত্রী বা স্বামীও ইসরায়েলের নাগরিক হতে পারে। অথচ যেসব ফিলিস্তিনি এই ভূখণ্ডে শত শত বছর ধরে বাস করতেন, তাদের ফিরে যাওয়ার অধিকার অস্বীকার করা হয়।

প্রথম ইন্তিফাদা (১৯৮৭–১৯৯৩): ইতিহাস ও গুরুত্ব

১৯৮৭ সালে গাজা উপত্যকায় শুরু হওয়া প্রথম ইন্তিফাদা ছিল ইসরায়েলের সামরিক দখল ও ফিলিস্তিনিদের ওপর ক্রমবর্ধমান শোষণ, বসতি স্থাপন এবং সম্মিলিত শাস্তির নীতির বিরুদ্ধে গণজাগরণের সূচনা। এই বিদ্রোহের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল অহিংস নাগরিক অবাধ্যতা, বিক্ষোভ, ও প্রতিবাদ, যা মূলত তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রিয়, যুব ও নারী কমিটিগুলির নেতৃত্বে পরিচালিত হত।

প্রথম ইন্তিফাদা শুধু একটি স্থানীয় বিদ্রোহ ছিল না, এটি পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক শান্তি প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে শান্তিপ্রিয় পরিবেশ তৈরি হওয়ায় এবং ১৯৮২ সালের মিশরীয়-ইসরায়েলি শান্তি চুক্তির সাফল্য থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে, ফিলিস্তিনি জাতীয় আন্দোলন আরও সুসংগঠিত হয়।

অবশেষে, ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি সংঘাতের শান্তিপ্রক্রিয়ার প্রথম বড় মাইলফলক ছিল। এই চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনি লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) তিউনিসিয়া থেকে পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় স্থানান্তরিত হয়ে ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করে।

তবে, এই শান্তিপ্রক্রিয়ায় সব পক্ষ সমর্থন জানায়নি। বিশেষ করে হামাসফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ শান্তি প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে যায়। এছাড়া, শান্তি চুক্তির বিরোধী হিসেবে পরিচিত ইসরায়েলের উগ্র ডানপন্থী গোষ্ঠীর সদস্যরা শান্তিপ্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে কাজ করে। ১৯৯৫ সালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইয়িৎসহাক রবিনকে একজন উগ্র ডানপন্থী হত্যার মধ্য দিয়ে শান্তি প্রক্রিয়া বড় ধরনের আঘাত পায়। এর ফলে ১৯৯৬ সালের নির্বাচন পরবর্তী ইসরায়েলি সরকার শান্তি প্রক্রিয়ায় আগ্রহ কমায়।

প্রথম ইন্তিফাদা ছিল ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য এক ঐতিহাসিক অধ্যায়, যা তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সূচনা। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা ও সাম্প্রতিক সংঘর্ষগুলো সংঘটিত হয়।

 

দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (২০০০-২০০৫): সহিংসতা ও প্রতিরোধের ধাপ

প্রথম ইন্তিফাদার পরবর্তী কয়েক বছরে শান্তি আলোচনা বারবার ব্যর্থ হওয়ার পর, ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে এক নতুন দম বন্ধ করা প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়, যা ইতিহাসে পরিচিত দ্বিতীয় ইন্তিফাদা বা আল-আকসা ইন্তিফাদা নামে। এটি ছিল ইসরায়েলের অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং গাজার বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সহিংস সংঘর্ষের সময়, যেখানে ফিলিস্তিনি জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে খোলাখুলি লড়াই শুরু হয়।

এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং ২০০৪ ও ২০০৫ সাল পর্যন্ত চলে। এই সময় হাজার হাজার মানুষ নিহত এবং আহত হয়। দ্বিতীয় ইন্তিফাদা ছিল প্রথম ইন্তিফাদের তুলনায় অনেক বেশি সহিংস ও প্রাণঘাতী। ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে ব্যাপক সামরিক অভিযান চালায়, আর ফিলিস্তিনি পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের হামলা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম সংঘটিত হয়।

২০০৫ সালে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আরিয়েল শ্যারন গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী ও সৈন্যদের সরানোর ঘোষণা দেন, যা "গাজা একসিডেন্টাল" নামে পরিচিত। ইসরায়েল ঘোষণা করে যে গাজায় তাদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ শেষ। তবে, জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে, কারণ ইসরায়েল এখনও গাজার আকাশসীমা, জলসীমা এবং সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে, যার ফলে তারা গাজার ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে।

এই সময়কাল ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সবচেয়ে কঠিন ও মানবিক বিপর্যয়ের সময় হিসেবে গণ্য। দ্বিতীয় ইন্তিফাদা যুদ্ধের ধারাবাহিকতা পরবর্তীতে আরও বৃহত্তর সংঘাতের সূচনা করে।

 

আল-আকসা মসজিদ” বা ফিলিস্তিন পতাকা

ফাতাহ-হামাস বিভক্তি ও গাজার সংকট (২০০৬-২০১৪)

২০০৬ সালে ফিলিস্তিনি সংসদীয় নির্বাচনে হামাস বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে ৪৪% ভোট পেয়ে সরকার গঠনে জয়লাভ করে। ইসরায়েল এবং পশ্চিমা দেশগুলো এই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে। তারা হামাসকে ইসরায়েলের অস্তিত্বের স্বীকৃতি দিতে, আগ্রাসন বন্ধ করতে এবং পূর্ববর্তী শান্তিচুক্তি মানতে চাপ দেয়। হামাস এই শর্তগুলো প্রত্যাখ্যান করলে ইসরায়েল ও পশ্চিমারা ফিলিস্তিনের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ২০০৭ সালে গাজা অঞ্চলে তীব্র সংঘাতে রূপ নেয়, যেখানে হামাস গাজার ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। এরপর থেকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দুই রাজনৈতিক ভাগে বিভক্ত — গাজায় হামাস, পশ্চিম তীরে ফাতাহ আধিপত্য বিস্তার করে। ইসরায়েল গাজার উপর কঠোর নৌ ও স্থল অবরোধ আরোপ করে, মিশরের সঙ্গে সমন্বয় করে গাজার সীমান্তও কঠোরভাবে বন্ধ রাখে।

২০০৮ সালের শেষের দিকে গাজায় উত্তেজনা চরমে ওঠে, যখন ইসরায়েল "কাস্ট লিড" নামে একটি বৃহৎ সামরিক অভিযান শুরু করে। এই অভিযানে হাজার হাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনি হতাহত হন এবং বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলেও, দখলদারিত্ব ও সহিংসতা অব্যাহত থাকে।

২০১১ সালে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ জাতিসংঘে পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়ার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়। ২০১২ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে “অ-সদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা আন্তর্জাতিক কূটনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল। এরপর ২০১৪ সালে গাজার সঙ্গে ইসরায়েলের মধ্যে ফের যুদ্ধ শুরু হয়, যার ফলে ৭০ জনেরও বেশি ইসরায়েলি এবং প্রায় ২০০০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন।

 

২০২৩-বর্তমান গাজা যুদ্ধ: আকস্মিক সংঘাত ও মানবিক বিপর্যয়

আরো পড়ুনঃ
ফিলিস্তিনের বর্তমান অবস্থা ২০২৫

২০১৪ সালের গাজার যুদ্ধ এবং ২০২১ সালের সংকটের পরে, হামাস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নতুন ধরনের আক্রমণের পরিকল্পনা শুরু করে। ২০২২ সালে নেতানিয়াহু আবার ক্ষমতায় আসেন এবং একটি কট্টরপন্থী, উগ্র ডানপন্থী সরকার গঠন করেন, যার কারণে ইসরায়েলে গভীর রাজনৈতিক সংঘাত দেখা দেয় এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে উত্তেজনা তীব্র হয়।

এই উত্তেজনার চরম পরিণতি ঘটে ৭ অক্টোবর ২০২৩, যখন গাজা উপত্যকা থেকে হামাস ও অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠী দক্ষিণ ইসরায়েলে আকস্মিক হামলা চালায়। এই হামলায় ১,২০০ জনেরও বেশি ইসরায়েলি বেসামরিক ও সামরিক কর্মী নিহত হন, আর প্রায় ২৫০ জনকে গাজায় জিম্মি করা হয়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দ্রুত যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং গাজায় ব্যাপক বিমানবোমাবর্ষণ ও সামরিক অভিযান শুরু করে। তাদের লক্ষ্য ছিল হামাসকে পরাজিত করা, জিম্মিদের মুক্ত করা এবং গাজার নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণে আনা।

এই যুদ্ধের ফলে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি, বেসামরিকসহ, নিহত হয় এবং প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক বিচার আদালত, ইসরায়েলকে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করে এবং যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। আদালত ইসরায়েলকে ১৯৪৮ সালের গণহত্যা প্রতিরোধ কনভেনশন অনুসারে সন্ত্রাস ও গণহত্যার যাবতীয় কার্যক্রম থামাতে নির্দেশ দেয়, তবে সামরিক অভিযান বন্ধ করার আদেশ দেয়নি।

যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে ইসরায়েল পশ্চিম তীরে মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় এবং লেবানন ও সিরিয়ায় ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। একই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেন, ইরাক ও সিরিয়ায় বিমান হামলা চালায়, যেখানে হুথি গোষ্ঠী প্রতিবাদস্বরূপ লোহিত সাগর অবরোধ করে।

 

শিশুদের কষ্ট, গাজার ধ্বংসস্তূপ

🕰️ ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের সময়রেখা (Timeline)

সালঘটনা
১৯১৭ব্যালফোর ঘোষণা: ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রতি সমর্থন জানায়।
১৯৪৮ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা — ফিলিস্তিনিদের ব্যাপক উচ্ছেদ (নাকবা)।
১৯৬৭ছয় দিনের যুদ্ধ: ইসরায়েল পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে।
১৯৮৭প্রথম ইন্তিফাদা (প্যালেস্টিনিয়ান গণ-আন্দোলন)।
২০০০দ্বিতীয় ইন্তিফাদা: অধিক দমন-পীড়নের প্রতিক্রিয়ায়।
২০০৭হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয় → ইসরায়েল গাজা অবরোধ শুরু করে।
২০১৪বড় আকারে গাজা যুদ্ধ (২,২০০+ ফিলিস্তিনি নিহত)।
২০২১আল-আকসা আগ্রাসন ও গাজা যুদ্ধ (১১ দিনের সংঘর্ষ)।
২০২৩৭ অক্টোবর: হামাস ইসরায়েলে হামলা → ইসরায়েল ব্যাপক প্রতিশোধমূলক যুদ্ধ শুরু।
২০২5গাজার ৭০% ধ্বংসপ্রাপ্ত, লাখ লাখ গৃহহীন, মানবিক বিপর্যয় চরমে।

 

ফিলিস্তিনের ইতিহাস বিস্তারিত পড়ুনঃ
ফিলিস্তিনের ইতিহাস ও ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা

 

পক্ষগুলোর ভূমিকা

🔴 ফিলিস্তিনপন্থী পক্ষসমূহ:

  • হামাস: গাজা শাসন করছে; ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধ’ চালিয়ে যাচ্ছে।
  • ফাতাহ/পিএলও: পশ্চিম তীরে সক্রিয়; কিছুটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষপাতী।
  • ইরান, কাতার, তুরস্ক: হামাসকে সমর্থন বা সহায়তা দিয়ে থাকে।
  • সাধারণ ফিলিস্তিনি জনগণ: নিরস্ত্র, কিন্তু আক্রান্ত; প্রতিদিন মানবিক বিপর্যয়ের মুখে।

🔵 ইসরায়েলপন্থী পক্ষসমূহ:

  • ইসরায়েল সরকার ও সেনাবাহিনী (IDF): ফিলিস্তিন দখল ও নিরাপত্তার নামে সামরিক অভিযান চালায়।
  • যুক্তরাষ্ট্র: সবসময় ইসরায়েলের পক্ষে; অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে।
  • ইউরোপীয় ইউনিয়ন: মানবিক সহায়তা দিলেও ইসরায়েলের প্রতি নরম মনোভাব।
  • বিভিন্ন পশ্চিমা মিডিয়া: ইসরায়েলপন্থী প্রচারণা করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

 

🕌 ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি

✡️ ইহুদি দৃষ্টিভঙ্গি:

  • ফিলিস্তিন (বিশেষত জেরুজালেম) তাদের প্রাচীন "ঈশ্বরপ্রদত্ত" ভূমি বলে দাবি করে।
  • টোরাহ ও তানাখ (ইহুদি ধর্মগ্রন্থ) অনুযায়ী, “বিধিত” বা “প্রতিশ্রুতভূমি”।

☪️ ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি:

  • ফিলিস্তিন ইসলামের প্রথম কিবলা — আল-আকসা মসজিদ এখানেই অবস্থিত।
  • হাদীস অনুযায়ী, কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে মুসলিম ও ইহুদিদের মধ্যে সংঘর্ষ হবে — ফিলিস্তিন তার প্রধান কেন্দ্র।
  • মুসলিমদের বিশ্বাস, ফিলিস্তিন একটি পবিত্র ভূমি যা মুসলিম উম্মাহর সম্পদ।
  • ইসলামে অন্যায় দখল ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা ফরজ।

✝️ খ্রিস্টান দৃষ্টিভঙ্গিও আছে:

  • জেরুজালেম খ্রিস্টানদের জন্যও পবিত্র, তবে সংঘাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে না।

 

 

প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)

১. ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের মূল কারণ কী?
ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের মূল কারণ হলো ভূমি দখল, রাজনৈতিক আধিপত্য এবং ধর্মীয়-ঐতিহাসিক বিরোধ। ইহুদি ও ফিলিস্তিনি দুই পক্ষই ঐ অঞ্চলে নিজেদের সার্বভৌমত্ব দাবি করে এবং এর ফলে সংঘাত ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।

২. কখন থেকে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত শুরু হয়?
এই সংঘাতের সূত্রপাত হয় ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আরব রাষ্ট্র ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে প্রথম আরব-ইসরাইলি যুদ্ধের মাধ্যমে। তারপর থেকে বিভিন্ন সময়ে বড়-বড় যুদ্ধ ও সংঘর্ষ ঘটেছে।

৩. ধর্মীয় ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
জেরুজালেম ও আল আকসা মসজিদের মতো পবিত্র স্থানগুলো ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা উভয় পক্ষের মধ্যে বিরোধের অন্যতম কারণ।

৪. আন্তর্জাতিক সমাজ এই সমস্যার সমাধানে কী ভূমিকা পালন করছে?
জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশ বিভিন্ন শান্তি প্রক্রিয়া এবং মধ্যস্থতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তবে এখনো স্থায়ী সমাধান মেলেনি।

৫. ফিলিস্তিনিদের জন্য এই সংঘাতের মানবিক প্রভাব কী?
দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতের ফলে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি গৃহহীন, উদ্বাস্তু ও অর্থনৈতিক দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছে, যা মানবাধিকার ও সামাজিক উন্নয়নের বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিছক একটি সীমান্ত যুদ্ধ নয়। এটি ইতিহাস, ধর্ম, ভূরাজনীতি, মানবাধিকার, ও উপনিবেশবাদের গভীর মিশ্রণ। যুদ্ধ যতই দীর্ঘ হোক, একথা স্পষ্ট: ফিলিস্তিনি জাতি তাদের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষায় সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। আর এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত হওয়াও সময়ের দাবি।