
মব জাস্টিস কী? বাংলাদেশে মব বিচার ও বাস্তবতা বিশ্লেষণ | 2025 আপডেট
মব কী? বাংলাদেশে এর বাস্তবতা
মব (Mob) শব্দটি সাধারণভাবে বোঝায় উত্তেজিত জনতার একটি দল, যারা হঠাৎ করে কোনো ঘটনা বা গুজবের প্রতিক্রিয়ায় সংঘবদ্ধ হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। এটি কখনো শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ হলেও, বেশিরভাগ সময় এটি সহিংসতা, হামলা বা বিচারবহির্ভূত শাস্তি (mob lynching)–তে রূপ নেয়। বাংলাদেশে গত এক দশকে মব আচরণের (mob behavior) আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিশেষ করে গুজব, সন্দেহ বা ধর্মীয় উসকানিতে মানুষ হঠাৎ জড়ো হয়ে নিরীহ ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করছে।
এ ধরনের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং উত্তেজনা আরও বাড়ায়। যেমন ২০১৯ সালে রাজধানীর উত্তরায় “শিশু অপহরণকারী” সন্দেহে একজন নারীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, পরে প্রমাণিত হয় তিনি ছিলেন একজন নিরীহ পথচারী। এ ছাড়া ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সম্প্রতি রংপুর, নরসিংদী, ও নেত্রকোনা জেলাতেও এমন নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। মব লিঞ্চিংয়ের ঘটনায় মূলত আইনের প্রতি অবিশ্বাস, বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, জনসচেতনতার অভাব ও ইন্টারনেটে গুজব ছড়ানোর প্রবণতা দায়ী।
বাংলাদেশ সরকার একাধিকবার এই বিষয়ে হুঁশিয়ারি ও আইনি পদক্ষেপ নিলেও এখনো “মব ন্যায়বিচার” একটি বড় সামাজিক সংকটে পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধুমাত্র আইন নয়, শিক্ষা, মিডিয়া সচেতনতা, দ্রুত বিচার ও সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলার মাধ্যমেই এই প্রবণতা রোধ করা সম্ভব। কারণ, একজন মানুষ গুজবের ভিত্তিতে গণপিটুনিতে প্রাণ হারালে শুধু আইন নয়, মানবতা ও সভ্যতাও হারিয়ে যায়।
মব জাস্টিস কী?
মব জাস্টিস (Mob Justice) বলতে বোঝানো হয়, যখন উত্তেজিত বা ক্ষুব্ধ জনতা নিজেরাই অপরাধী মনে করা ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিচার ও শাস্তি কার্যকর করে, আইন-আদালতের শরণাপন্ন না হয়ে। এটি সাধারণত সংঘবদ্ধভাবে করা হয় এবং প্রায়শই সহিংস আকার ধারণ করে—যেমন গণপিটুনি, সম্পত্তি ধ্বংস, এমনকি হত্যাও। মব জাস্টিস মূলত জন্ম নেয় আইন-শৃঙ্খলার প্রতি অবিশ্বাস, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা ও সমাজে দ্রুত প্রতিক্রিয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে। অনেক সময় গুজব বা সন্দেহের ভিত্তিতে নিরীহ মানুষও এই ধরনের বিচারহীন সহিংসতার শিকার হন।
বাংলাদেশে সম্প্রতি মব জাস্টিসের অনেক ভয়াবহ উদাহরণ দেখা গেছে, যেখানে চোর সন্দেহে, ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে কিংবা শিশুচোর অপবাদে অনেক নিরপরাধ মানুষ গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। এই ধরনের 'বিচার' আসলে আইন ও মানবাধিকারের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। রাষ্ট্রের আইনি কাঠামো এবং মানবিক মূল্যবোধ উভয়ের জন্যই এটি একটি চরম হুমকি।
মব জাস্টিস কোনো ন্যায়বিচার নয়, বরং এটি অন্যায়কে আরও বড় অন্যায় দিয়ে ঢাকার চেষ্টা, যা সমাজে ভয়, অস্থিরতা এবং আইনহীনতার সংস্কৃতি সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশে মব জাস্টিসের বাস্তব চিত্র
বাংলাদেশে মব জাস্টিস এখন একটি উদ্বেগজনক সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, আইন প্রয়োগের দুর্বলতা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ সমস্যার পেছনে প্রধান চালিকা শক্তি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে “চোর”, “শিশুচোর”, “ধর্ম অবমাননা” বা “ধর্ষক” বলে সন্দেহ করে উত্তেজিত জনতা অনেক নিরপরাধ মানুষকে গণপিটুনিতে হত্যা করেছে। যেমন ২০১৯ সালের জুলাই মাসে রাজধানীর উত্তরায় রুমানা নামে এক নারীকে “শিশুচোর” সন্দেহে জনতা পিটিয়ে হত্যা করে—পরে প্রমাণ হয় তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নির্দোষ। একই বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে এমন গুজব, যার ফলে এক মাসেই ৮ জন প্রাণ হারান।
এছাড়া, ধর্মীয় ইস্যুতে মব জাস্টিস আরও ভয়ংকর রূপ নেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে কুমিল্লা, নাসিরনগর ও রংপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা চালানো হয়েছে, যেটা মূলত উস্কানিমূলক পোস্ট ও গুজবের ওপর ভিত্তি করে সংঘটিত হয়।
এই ধরনের ঘটনাগুলো শুধু ব্যক্তির জীবনের জন্য হুমকি নয়, বরং আইনের শাসন, সামাজিক সহনশীলতা ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য মারাত্মক হুমকি। অনেক সময় পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও উত্তেজিত জনতাকে থামাতে ব্যর্থ হয়, কিংবা গণচাপের মুখে নিষ্ক্রিয় থাকে। ফলে একদিকে বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি জোরদার হয়, অন্যদিকে নিরীহ মানুষের জীবন চলে যায় অন্যায়ের শিকার হয়ে।
সরকার মাঝেমধ্যে এ ধরনের ঘটনার নিন্দা জানালেও কার্যকর ব্যবস্থা ও দ্রুত বিচার না থাকায় মব জাস্টিস যেন একটা “অলিখিত সংস্কৃতি” হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে কেবল আইন প্রয়োগ নয়, চাই জনসচেতনতা, শিক্ষার প্রসার, সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ ও বিচারব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের আস্থা ফেরানো।
মব জাস্টিসের কারণ ও প্রতিকার
বাংলাদেশে মব জাস্টিস বা গণপিটুনির ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে, যা সমাজে আইনহীনতা ও সহিংসতার সংস্কৃতিকে উদ্বুদ্ধ করছে। এর পেছনে কয়েকটি মূল কারণ রয়েছে। প্রথমত, বিচার ব্যবস্থার ধীরগতি ও দীর্ঘসূত্রতা, যার ফলে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা হারিয়ে নিজেরাই শাস্তি দিতে উদ্যত হয়। দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি মানুষের অনাস্থা ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, বিশেষ করে ঘটনাস্থলে পুলিশ উপস্থিত থাকলেও অনেক সময় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। তৃতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে পড়া, যা মুহূর্তেই উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এছাড়া, শিক্ষার অভাব, নৈতিক অবক্ষয়, এবং সাংবাদিকতার দায়িত্বহীনতা অনেক সময় উত্তেজনায় ঘি ঢালে।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রতিকার করতে হলে চাই সমন্বিত পদক্ষেপ। প্রথমত, বিচার ব্যবস্থাকে আরও দ্রুত, স্বচ্ছ ও জনগণের নাগালের মধ্যে আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দক্ষতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে, যাতে তারা মব নিয়ন্ত্রণে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে। তৃতীয়ত, গুজব নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পর্যবেক্ষণ ও গণসচেতনতা কর্মসূচি চালানো জরুরি। মিডিয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় নেতাদের এ বিষয়ে সচেতন ভূমিকা নিতে হবে। সর্বোপরি, নাগরিক সমাজকে আইনের প্রতি আস্থা রাখতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মব জাস্টিস কোনো সমাধান নয়, বরং এটি এক ধরনের বিচারবহির্ভূত বর্বরতা, যা রাষ্ট্র ও সমাজ—উভয়ের জন্যই হুমকিস্বরূপ।
বাংলাদেশে সম্প্রতি আলোচিত মব জাস্টিস ঘটনা
১৪ জুন ২০২৫-এর দিপনগর গণপিটুনি
ঢাকার দিপনগর এলাকায় মাদক বিক্রির অভিযোগে দুই তরুণকে গলা কেটে হত্যা করে স্থানীয় জনতা tbsnews.net। Ain o Salish Kendra–এর প্রতিবেদনে বলা হয়, অগাস্ট ২০২৪–মে ২০২৫ পর্যন্ত ৮ বিভাগে এক্ষেত্রে ১৭২ জন নিহত হয়েছে ।
আগস্ট ২০২৪–এপ্রিল ২০২৫: ১৬১ জন লিঞ্চিং
Ain o Salish Kendra–র তথ্য অনুযায়ী, ওই সময়সীমায় ১৬১ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ।
জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারি ২০২৫: ৩০টি ঘটনা, ১৯ জন নিহত
Human Rights Support Society (HRSS) অনুযায়ী, মাত্র দুই মাসে ৩০টি ঘটনার মাধ্যমে ১৯ জন নিহত ও ২০ জন আহত হয়েছেন ।
উত্তরা ও টঙ্গি: গণপিটুিতে ভাইরাল ভিডিও
উত্তরায় মোটা দায়ে সন্দেহে দুইজনকে উল্টে ঝুলিয়ে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছিল, টঙ্গিতে এক যুবক নিহত হয় ।
ধর্মীয় গুজবের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ড
মার্চ ২০২৫-এ চট্টগ্রামের আলিয়াপুর এলাকায় মসজিদ থেকে মিথ্যা ঘোষণা কম্পনিয়ে চিহ্নিত দুজনকে গলা ও মেরে ফেলা হয়েছিল ।
ভাইরাল ধর্ষণ-সম্পর্কিত গুজব ও আগুনে পুড়া বাড়ি
মাগুরার ধর্ষণ-ঘটনার প্রতিবাদের সময় অভিযুক্তের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় এবং মিছিলের অংশ হিসেবে বাড়ি পুড়ে যায় ।
বিদেশী নাগরিকদের উপর পিটুনি
ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ফ্লুয়ারের লাইভ টাকার বদল ঘিরে দুই ইরানি নাগরিক ও এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে আহত করা হয় ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের অতিথিকক্ষে তোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়
সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ
- ন্যায়বিচারহীনতা ও আইনের টিকিটিকি: দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া ও আইনি বিশ্বাসহীনতা জনসাধারণকে নিজে আইন চালানোর দিকে ঠেলে যুগোপযোগী।
- গুজব ও সামাজিক মাধ্যম প্রসার: ভয়, সন্দেহ ও গুজব দ্রুত ছড়িয়ে জনতা সহিংসতায় প্রবল হয় ।
- ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রভাব: ধর্মীয় উসকানিমূলক ঘটনা মতো ধর্ম অবমাননা দেখিয়ে জনতা সংঘটিত সহিংসতা জোরালো হয়েছে ।
- আইন প্রয়োগে দুর্বলতা: পুলিশ প্রায়ই হ্যাণ্ডল করতে না পেরে, নীরব সাপেক্ষে অপরাধীরা বেকায়দায় পড়ে ।
বাংলাদেশে মব জাস্টিসের উত্থান শুধুমাত্র একাধিক ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটাচ্ছে না—এটি আইনের শাসন ও মানবাধিকার ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে। এটি রোধ করতে হলে প্রয়োজন:
- দ্রুত ও কার্যকর বিচার ব্যবস্থা,
- সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব দমনেচেষ্টা,
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও পুলিশি হস্তক্ষেপ,
- এবং শিক্ষা ও সামাজিক মূল্যবোধ জাগরণ।
FAQ (প্রশ্নোত্তর):
❓ মব জাস্টিস কী?
উত্তর: মব জাস্টিস হলো যখন উত্তেজিত জনতা কোনো অপরাধী মনে করা ব্যক্তিকে বিচার না করে নিজে শাস্তি দেয়—যেমন গণপিটুনি বা হত্যা।
❓ বাংলাদেশে মব জাস্টিস কেন বাড়ছে?
উত্তর: বিচারপ্রক্রিয়ার ধীরগতি, আইন প্রয়োগে দুর্বলতা, গুজব ও সামাজিক সচেতনতার অভাব মব জাস্টিস বাড়ার প্রধান কারণ।
❓ মব জাস্টিস কি আইনত বৈধ?
উত্তর: না, মব জাস্টিস সম্পূর্ণ বেআইনি এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
❓ মব লিঞ্চিং ও মব জাস্টিস এক জিনিস?
উত্তর: হ্যাঁ, মব লিঞ্চিং হলো মব জাস্টিসের চরম রূপ, যেখানে জনতা কাউকে পিটিয়ে হত্যা করে।
❓ মব জাস্টিস বন্ধে করণীয় কী?
উত্তর: জনসচেতনতা বাড়ানো, সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব নিয়ন্ত্রণ, বিচার দ্রুত সম্পন্ন করা এবং পুলিশি হস্তক্ষেপ জোরদার করা।
মন্তব্য করুন
Your email address will not be published.