
যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ সংশোধনী: নতুন বিধান, ব্যাখ্যা ও সমালোচনা
বাংলাদেশে যৌতুক একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি, যা নারীর প্রতি সহিংসতার অন্যতম প্রধান কারণ। এ সমস্যা রোধে সরকার ২০১৮ সালে “যৌতুক নিরোধ আইন” প্রণয়ন করে, যার মাধ্যমে পুরনো ১৯৮০ সালের আইনকে বাতিল করে আরও কঠোর ও যুগোপযোগী কাঠামো তৈরি করা হয়। ২০২৫ সালে এ আইনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয়েছে, যার লক্ষ্য হলো আইনটির অপব্যবহার বন্ধ করা এবং বিচার প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর ও বাস্তবমুখী করা।
যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮: সংক্ষেপে মূল কাঠামো
- যৌতুক দাবি, গ্রহণ বা প্রদান শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
- সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড ও ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা।
- মিথ্যা মামলা প্রমাণিত হলে অভিযোগকারীকে একই শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
- অপরাধ অজামিনযোগ্য, এবং সান্ধ্য বিচার আদালতে বিচারযোগ্য।
২০২৫ সালের সংশোধনী: কী পরিবর্তন হলো?
২০২৫ সালের জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া সংশোধনী অনুযায়ী:
- সাধারণ জখম সম্পর্কিত যৌতুক মামলা দায়ের করার আগে বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা করতে হবে।
- এর জন্য ভুক্তভোগীকে লিগ্যাল এইড অফিসে আবেদন করতে হবে।
- দুই সপ্তাহের মধ্যে আপস না হলে মামলা দায়েরের সুযোগ থাকবে।
2. ভুয়া বা মিথ্যা মামলা রোধে আইনের ৬(২) ধারা অনুযায়ী অভিযোগকারীকে শাস্তির আওতায় আনার সুযোগ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
3. আদালতে মামলার আগে ডকুমেন্টারি প্রমাণ, যেমন মেডিকেল রিপোর্ট, ভিডিও, অডিও, বা সাক্ষী, জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে।
যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ সংশোধনী: বাধ্যতামূলক মামলাপূর্ব মধ্যস্থতার নতুন বিধান
২০২৫ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া ‘আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর মাধ্যমে যৌতুকজনিত সাধারণ জখম মামলার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন থেকে এমন মামলার পূর্বে ভুক্তভোগী নারীকে অবশ্যই লিগ্যাল এইড অফিসে মধ্যস্থতার জন্য আবেদন করতে হবে। বিনা খরচে এই মধ্যস্থতার প্রক্রিয়ায় দুই পক্ষের মধ্যে আপস না হলে, যেকোনো পক্ষ পরে আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবে। এই পরিবর্তন আনা হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ১১(গ) ধারা এবং যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮-এর ৩ ও ৪ ধারার অধীনে সংঘটিত সাধারণ জখম মামলাগুলোর ক্ষেত্রে। নতুন অধ্যাদেশে আইনের ২১(খ) ধারা সংযোজন করে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, মামলার আগে মধ্যস্থতা বাধ্যতামূলক—যদিও প্রচলিত অন্য কোনো আইনে ভিন্ন কিছু থাকলেও এই নতুন বিধান কার্যকর থাকবে।
সংশোধিত আইনে বলা হয়, যৌতুকের কারণে যদি কোনো নারীকে তাঁর স্বামী বা স্বামীর পরিবার সাধারণ জখম করে, তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছর এবং ন্যূনতম দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অতীতে এসব মামলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে চললেও, এখন থেকে তা প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন হবে। তবে ২৫ মার্চ ২০২৫-এর আগে দায়ের হওয়া মামলা আগের মতো ট্রাইব্যুনালেই চলবে, কোনো পরিবর্তন হবে না।
এই সংশোধনী নিয়ে সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেক আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী মনে করেন, বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা নারীদের বিচারপ্রাপ্তির অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। ভুক্তভোগীদের অপরাধীর সঙ্গে আপসে বাধ্য করা, বা প্রভাব খাটিয়ে চাপ সৃষ্টি করার সম্ভাবনা থেকেই যায়। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের মতে, এটি নারীর অধিকারকে ব্যাহত করার পরিবর্তে বরং শক্তিশালী করবে। কারণ, যৌতুকজনিত সাধারণ জখম ইতোমধ্যে উচ্চ আদালতের রায়ে একটি আপসযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অনেক সময় মামলা প্রমাণ করা এবং দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়ায় যাওয়ার পরিবর্তে নারীরা নিজেরাই আপস করতে চান। নতুন আইনের ফলে তারা এখন শুরুতেই বিনা খরচে মধ্যস্থতার মাধ্যমে দ্রুত নিষ্পত্তির সুযোগ পাবেন। যদি আপস না হয়, তবে মামলা দায়েরের অধিকার তাদের জন্য সংরক্ষিতই থাকবে।
এই প্রক্রিয়া যেন হয় ন্যায়সংগত, সময়োপযোগী ও নারীবান্ধব—তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সঠিক বাস্তবায়ন, লিগ্যাল এইড অফিসের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জনসচেতনতা। আইনটির লক্ষ্য যেন হয় বিচার নিশ্চিতকরণ, আপস চাপিয়ে দেওয়া নয়, সেটিই হওয়া উচিত রাষ্ট্র ও সমাজের মূল অঙ্গীকার।
এই সংশোধনী অনেকের মতে যৌতুকবিরোধী আইনের যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। কারণ, বাস্তবে অনেক সময় ভুয়া অভিযোগের কারণে নিরীহ পুরুষরা হয়রানির শিকার হন। ফলে মধ্যস্থতা বাধ্যতামূলক করার ফলে অপ্রয়োজনীয় মামলা এড়ানো যাবে।
তবে, মানবাধিকার কর্মী ও নারী অধিকার সংগঠনগুলো বলছে—এই বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতা নারীর ন্যায়বিচারের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। গ্রামাঞ্চলে ও দরিদ্র নারীদের ক্ষেত্রে বিচার প্রাপ্তি আরও কঠিন হয়ে পড়বে। অনেক সময় অপরাধী মধ্যস্থতার সময় প্রভাব খাটিয়ে ভুক্তভোগীকে চাপে ফেলে আপসে বাধ্য করতে পারে।
যৌতুক মামলা কোন আইনে কী পার্থক্য? এক নজরে
বৈশিষ্ট্য | যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ (ধারা ৩) | নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (ধারা ১১/গ) |
মূল অপরাধ | শুধু যৌতুক দাবি করা | যৌতুকের জন্য মারধর/নির্যাতন করা |
শাস্তি (জেল) | ১ থেকে ৫ বছর | ২থেকে ৫ বছর (সশ্রম) |
শাস্তি (জরিমানা) | সর্বোচ্চ ৫০,০০০ টাকা | জেলের সাথে অতিরিক্ত জরিমানা |
জামিন | জামিন যোগ্য নয়, তবে জামিন পাওয়া যায় | জামিনযোগ্য নয় |
আপোষ | করা যায় | আপোষযোগ্য নয় |
বিচার কোথায় হয় | ম্যাজিস্ট্রেট আদালত | নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল |
বাস্তব প্রয়োগে চ্যালেঞ্জ
- লিগ্যাল এইড অফিসগুলোতে যথেষ্ট প্রশিক্ষিত জনবল না থাকায় কার্যকর মধ্যস্থতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
- গ্রামে প্রভাবশালী পক্ষ কর্তৃক আপস চাপিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা।
- অনেক ভুক্তভোগী এই নতুন নিয়ম সম্পর্কে অবগত না থাকায় বিচারপ্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে।
যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ সংশোধনীর মাধ্যমে আইনটি আরও শক্তিশালী ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে বটে, তবে এর কার্যকর প্রয়োগের জন্য চাই সচেতনতা, প্রশাসনিক দক্ষতা, এবং নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর আইনি কাঠামো তখনই বাস্তবায়ন সম্ভব হবে, যখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ এবং সমাজ একযোগে কাজ করবে।
এই সংশোধনী যেন বিচারহীনতা তৈরি না করে, বরং সঠিক বিচার নিশ্চিত করে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আরো পড়ুনঃ
পদ্মা সেতুর টোল কত বছর নেওয়া হবে ও কত টাকা উঠছে? জানুন বিস্তারিত হিসাব ২০২৫
FAQ (প্রশ্নোত্তর):
❓ যৌতুক নিরোধ আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি কী?
উত্তর: সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড এবং ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা।
❓ নতুন সংশোধনী অনুযায়ী মামলা করার আগে কী করতে হবে?
উত্তর: সাধারণ জখমের যৌতুক মামলার আগে বাধ্যতামূলকভাবে মধ্যস্থতা করতে হবে লিগ্যাল এইড অফিসে।
❓ যদি মিথ্যা মামলা প্রমাণিত হয় তাহলে কী শাস্তি?
উত্তর: অভিযোগকারীকে একই মাত্রার শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে—৫ বছর জেল ও জরিমানা।
❓ আইনটি সবার জন্য সমানভাবে কার্যকর হচ্ছে কি?
উত্তর: অনেক ক্ষেত্রে নারী ভুক্তভোগীরা বাধা পান। তাই সমানভাবে কার্যকর করতে প্রয়োজন সচেতনতা ও নিরপেক্ষতা।
মন্তব্য করুন
Your email address will not be published.