sura bakarar sesh dui ayat_1750051130.jpg

সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত - অর্থ, উচ্চারণ ও ফজিলত

সুরা আল-বাক্বারার শেষ দুই আয়াত কেবল কোরআনের একটি অংশ নয়, বরং মুসলিম জীবনের জন্য এক মহান আশীর্বাদ। এই আয়াতদ্বয় আমাদের ঈমান, আত্মসমর্পণ, ক্ষমা প্রার্থনা এবং আল্লাহর প্রতি আস্থা ও নির্ভরতার শিক্ষায় সমৃদ্ধ করে। রাসূল (সা.) নিজেই এর ফজিলত সম্পর্কে বলেছেন যে, “যে ব্যক্তি রাতে এই দুই আয়াত পাঠ করবে, তা তার জন্য যথেষ্ট হবে।”

 

🕋 আরবি:

আয়াত ২৮৫:

آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مِن رَّبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ ۚ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّن رُّسُلِهِ ۚ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا ۖ غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ

আয়াত ২৮৬:

لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا ۚ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَعَلَيْهَا مَا اكْتَسَبَتْ ۗ رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِن نَّسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا ۚ رَبَّنَا وَلَا تَحْمِلْ عَلَيْنَا إِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِنَا ۚ رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِ ۖ وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا ۚ أَنتَ مَوْلَانَا فَانصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ

 

বাংলা উচ্চারণ:

📖 সুরা আল-বাক্বারা – আয়াত ২৮৫
"আমানা র-রাসূলু বিমা উনজিলা ইলাইহি মির-রাব্বিহি ওয়াল-মু’মিনূন। কুল্লুন আমানা বিল্লাহি ওয়া মালা-ইকাতিহি ওয়া কুতুবিহি ওয়া রুসুলিহি। লা নুফাররিকু বাইনা আহাদিম-মির রুসুলিহি। ওয়াকালু সামি’না ওয়া আতা’না, গুফরানাকা রাব্বানা ওয়া ইলাইকাল মাসীর।"

📖 সুরা আল-বাক্বারা – আয়াত ২৮৬
"লা ইউকাল্লিফুল্লাহু নাফসান ইল্লা উসআহা। লাহা মা কাসাবাত, ওয়া আলাইহা মাকтасাবাত।
রাব্বানা লা তু’আখিজনা ইন্-নাসিনা আও আখতো’না।
রাব্বানা ওয়া লা তাহমিল ‘আলাইনা ইসরান কামা হামালতাহু ‘আলাল্লাজিনা মিন কাবলিনা।
রাব্বানা ওয়া লা তুহাম্মিলনা মা লা ত্বাকাতা লানা বিহি।
ওয়া’ফু আন্না, ওয়াগফির লানা, ওয়ারহামনা।
আন্তা মাওলানা, ফানসুরনা ‘আলাল কাওমিল কাফিরীন।"

 

📚 বাংলা অনুবাদ:

২৮৫:

(২৮৫) রসূল তার প্রতি তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতে সে বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং বিশ্বাসিগণও; সকলে আল্লাহতে, তাঁর ফিরিশতাগণে, তাঁর কিতাবসমূহে এবং তাঁর রসূলগণে বিশ্বাস স্থাপন করেছে। (তারা বলে,) আমরা তাঁর রসূলগণের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না।[1] আর তারা বলে, আমরা শুনলাম ও মান্য করলাম! হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তোমার ক্ষমা চাই, আর তোমারই দিকে (আমাদের) প্রত্যাবর্তন হবে।

তাফসিরঃ
[1] এই আয়াতে এমন কিছু বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে, যার উপর ঈমানদারদেরকে ঈমান আনতে বলা হয়েছে। এর পরের {لاَ يُكَلِّفُ اللهُ} আয়াতে আল্লাহর রহমত, তাঁর দয়া এবং তাঁর অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তিনি মানুষকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না। হাদীসে এই শেষ দুটি আয়াতের অনেক ফযীলতের কথা এসেছে। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি সূরা বাক্বারার শেষের দু’টি আয়াত রাতে পড়ে নেয়, তার জন্য এই আয়াত দু’টিই যথেষ্ট হয়ে যায়।’’ (বুখারী, ইবনে কাসীর) অর্থাৎ, এই আমলের কারণে মহান আল্লাহ তার হেফাযত করবেন। অপর একটি হাদীসে এসেছে, নবী করীম (সাঃ) মিরাজের রাতে যে তিনটি জিনিস পেয়েছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল, সূরা বাক্বারার শেষের এই দু’টি আয়াত। (সহীহ মুসলিম) অনেক বর্ণনায় এ কথাও এসেছে যে, এই সূরার শেষের আয়াত দু’টি রসূল (সাঃ)-কে আরশের নীচের একটি ভান্ডার থেকে দেওয়া হয় এবং এই আয়াত কেবল তাঁকেই দেওয়া হয়, অন্য কোন নবীকে দেওয়া হয়নি। (আহমদ, নাসায়ী, ত্বাবারানী, বায়হাক্বী, হাকেম এবং দারেমী ইত্যাদি।) মুআয (রাঃ) এই সূরা শেষ করে ‘আমীন’ বলতেন।’’ (ইবনে কাসীর)

২৮৬:

২৮৬. আল্লাহ কারো উপর এমন কোন দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না যা তার সাধ্যাতীত(১)। সে ভাল যা উপার্জন করে তার প্রতিফল তারই, আর মন্দ যা কামাই করে তার প্রতিফল তার উপরই বার্তায়। হে আমাদের রব! যদি আমরা বিস্মৃত হই অথবা ভুল করি তবে আপনি আমাদেরকে পাকড়াও করবেন না। হে আমাদের রব! আমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর যেমন বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের উপর তেমন বোঝা চাপিয়ে দিবেন না। হে আমাদের রব! আপনি আমাদেরকে এমন কিছু বহন করাবেন না যার সামর্থ আমাদের নেই। আর আপনি আমাদের পাপ মোচন করুন, আমাদের ক্ষমা করুন, আমাদের প্রতি দয়া করুন, আপনিই আমাদের অভিভাবক। অতএব কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন(২)।

 

আরো পড়ুনঃ
সকাল ও সন্ধ্যার ২০টি জরুরি দোয়া (আরবি, বাংলা উচ্চারণ, অর্থ, ফজিলত ও হাদিসসহ)

 

তাফসিরঃ
(১) পূর্ববর্তী আয়াতে বলা হয়েছিল যে, তোমাদের অন্তরে যা আছে, প্রকাশ কর কিংবা গোপন রাখ সর্বাবস্থায় আল্লাহ্ তা'আলা তোমাদের কাছ থেকে তার হিসাব নেবেন। আয়াতের আসল উদ্দেশ্য ছিল এই যে, তোমরা স্বেচ্ছায় যেসব কাজ করবে, আল্লাহ তা'আলা তার হিসাব নেবেন। অনিচ্ছাকৃত কু-চিন্তা ও ক্রটি-বিচূতি এর অন্তর্ভুক্তই ছিল না। কিন্তু আয়াতের ভাষা বাহ্যতঃ ব্যাপক ছিল। এতে বোঝা যেত যে, অনিচ্ছকৃত ধারণারও হিসাব নেয়া হবে। এ আয়াত শুনে সাহাবায়ে কেরাম অস্থির হয়ে গেলেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আরয করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এতদিন আমরা মনে করতাম যে, আমাদের ইচ্ছাকৃত কাজেরই হিসাব হবে। মনে যেসব অনিচ্ছাকৃত কল্পনা আসে, সেগুলোর হিসাব হবে না। কিন্তু এ আয়াত দ্বারা জানা গেল যে, প্রতিটি কল্পনারও হিসাব হবে। এতে তো শাস্তির কবল থেকে মুক্তি পাওয়া সাংঘাতিক কঠিন মনে হয়।

মহানবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়াতের সঠিক উদ্দেশ্য জানতেন, কিন্তু উক্ত আয়াতে ব্যবহৃত শব্দের ব্যাপকতার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নিজের পক্ষ থেকে কিছু বলা সমীচীন মনে করলেন না, বরং ওহীর অপেক্ষায় রইলেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে আপাততঃ আদেশ দিলেন যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে যে নির্দেশ আসে, তা সহজ হোক কিংবা কঠিন - মুমিনের কাজ হলো তা মেনে নেয়া। সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশমত কাজ করলেন; যদিও তাদের মনে এ সংশয় ছিল যে, অনিচ্ছাকৃত কল্পনা ও কু-চিন্তা থেকে বেঁচে থাকা খুবই কঠিন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তা'আলা প্রথমে মুসলিমদের আনুগত্যের প্রশংসা করেন এবং বিশেষ ভঙ্গিতে ঐ সন্দেহের নিরসন করে বলেন, আল্লাহ তা'আলা কাউকে তার সাধ্যের বহির্ভূত কোন কাজের নির্দেশ দেন না।

কাজেই অনিচ্ছাকৃতভাবে যেসব কল্পনা ও কু-চিন্তা অন্তরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, এরপর সেগুলো কার্যে পরিণত করা না হয়, সেসব আল্লাহ তা'আলার কাছে মাফযোগ্য। যেসব কাজ ইচ্ছে করে করা হয়, শুধু সেগুলোরই হিসাব হবে। কুরআনে বর্ণিত এ ব্যাখ্যার ফলে সাহাবায়ে কেরামের মানসিক উদ্বেগ দূর হয়ে যায়। [মুসনাদে আহমাদ: ২/৪১২, ১/৩৩২: মুসলিম: ১২৫] তারপর আল্লাহ তা'আলা মুসলিমদেরকে একটি বিশেষ দো'আ শিক্ষা দিয়েছেন। যাতে ভুল-ভ্রান্তিবশতঃ কোন কাজ হয়ে যাওয়ার পর ক্ষমা প্রার্থনার পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়া হয়েছে এবং পূর্ববর্তী উম্মতদের মত শাস্তিও যেন এ উম্মতের উপর না আসে, তার জন্য বিশেষভাবে দো'আ করতে বলা হয়েছে।

(২) আলোচ্য আয়াত দুটি সূরা বাকারার শেষ আয়াত। সহীহ হাদীসসমূহে এ আয়াত দুটির বিশেষ ফয়ীলতের কথা বর্ণিত আছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ কেউ রাতের বেলায় এ আয়াত দুটি পাঠ করলে তা তার জন্য যথেষ্ট। [বুখারীঃ ৪০০৮, ৫০০৮, মুসলিমঃ ৮০৮] অর্থাৎ বিপদাপদ ও বিভিন্ন প্রকার অনিষ্ট থেকে মুক্ত থাকার জন্য যথেষ্ট।

 

🗓️ নাজিলের সময় ও স্থান:

এই দুই আয়াত মেরাজ রাতে সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে উপহারস্বরূপ প্রদান করা হয়।

তাই একে বলা হয় "আসমান থেকে সরাসরি দান" আয়াত।

এটি মদীনায় নাজিল হলেও, মেরাজের সময় এটি নাজিল হওয়ায় এটির মাহাত্ম্য আলাদা।

🌟 ফজিলত ও তাতপর্য:

✅ ১. বিশেষ রাত্রিকালীন ফজিলত:

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:

"যে ব্যক্তি রাতে সূরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত পাঠ করবে, তা তার জন্য যথেষ্ট হবে।"
— (বুখারী, হাদিস: ৫০০৯; মুসলিম, হাদিস: ৮০৮)

✅ ২. দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা:

দ্বিতীয় আয়াতে আছে খুবই গভীর দোয়া — ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা, শক্তির বাইরে দায়িত্ব না দেওয়ার আবেদন।

✅ ৩. আকিদা ও ঈমানের সারসংক্ষেপ:

প্রথম আয়াতে আছে ঈমানের মূল ভিত্তি — আল্লাহ, ফেরেশতা, কিতাব ও রাসূলদের প্রতি বিশ্বাস।

✅ ৪. রাসূল ও উম্মতের মধ্যকার সম্পর্ক:

এই আয়াত দু’টি আমাদের শেখায় কীভাবে রাসূল (সা.)-কে অনুসরণ করতে হয় এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হয়।

🤲 উপকারিতা:

শয়তানের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে।

রাতে ঘুমানোর আগে পড়লে আল্লাহর পক্ষ থেকে হেফাজত থাকে।

পাপ ক্ষমার দরজা খুলে দেয়।

দুঃখ-কষ্টে সান্ত্বনা দেয়।

অন্তরের প্রশান্তি এনে দেয়।

 

 প্রতিদিন রাতে এই আয়াত দুটি পাঠ করাকে অভ্যাসে পরিণত করা উচিত, যাতে আল্লাহর রহমত, নিরাপত্তা ও মাগফিরাত আমাদের জীবনের প্রতিটি অংশকে ঘিরে রাখে।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই আয়াতগুলোর শিক্ষা অনুযায়ী জীবন গড়ার তাওফিক দিন। আমিন।