
যাকাত কাকে বলে? কখন ফরজ হয়? কাদের উপর ফরজ? – সম্পূর্ণ গাইড
যাকাত ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ। এটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ থেকে নির্দিষ্ট হারে গরিবদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত একটি হক বা অধিকার। যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ (স্বর্ণ, রূপা, নগদ টাকা, ব্যবসার মাল ইত্যাদি) এক হিজরি বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে আপনার মালিকানায় থাকে — তাহলে যাকাত ফরজ হবে ।
🔸 আরবি অর্থ: পরিশুদ্ধি ও বৃদ্ধি।
🔸 ইসলামি সংজ্ঞা:
“যাকাত হল এমন একটি নির্ধারিত অংশ যা ধনীরা তাদের সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য গরিবদের মাঝে দান করে।”
📚 কুরআন:
"আর তোমরা সালাত কায়েম করো এবং যাকাত প্রদান করো..."
(সূরা বাকারাহ: ৪৩)
বর্তমানে কত টাকা থাকলে যাকাত ফরজ হয়?
🔹 যাকাত ফরজ হওয়ার মূল পরিমাণ (নিসাব):
যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য ব্যক্তির মালিকানায় থাকা সম্পদের পরিমাণ হতে হবে নিসাব পরিমাণ।
✅ স্বর্ণের হিসাবে নিসাব:
৮৭.৪৮ গ্রাম (প্রায় ৭.৫ তোলা) স্বর্ণ =
🪙 বাংলাদেশে আনুমানিক ৭৫,০০০ – ৮৫,০০০ টাকা বা তার বেশি।
✅ রূপার হিসাবে নিসাব:
৬১২.৩৬ গ্রাম (প্রায় ৫২.৫ তোলা) রূপা =
⚖️ আনুমানিক ৫,০০০ – ৮,০০০ টাকা বা তার বেশি।
📌 👉 সাধারণভাবে বর্তমানে রূপার নিসাব ধরা হয়, কারণ তা গরিবদের বেশি উপকারে আসে।
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত:
শর্ত | বিস্তারিত |
---|---|
১ইসলাম | যাকাত কেবল মুসলমানের উপর ফরজ |
স্বাধীনতা | দাস হলে যাকাত ফরজ নয় |
নিসাব পরিমাণ সম্পদ | এক চন্দ্র বছর ধরে নিসাব পরিমাণ সম্পদ স্থায়ীভাবে মালিকানায় থাকতে হবে |
ঋণমুক্ত হওয়া | মূল সম্পদ থেকে ঋণ বাদ দিলে নিসাব পরিমাণ থাকতে হবে |
প্রয়োজনাতিরিক্ত | বেসিক প্রয়োজন মেটানোর পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলেই ফরজ |
যাকাত কখন ফরজ হয়?
🔹 উত্তর:
যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ (স্বর্ণ, রূপা, নগদ টাকা, ব্যবসার মাল ইত্যাদি) এক হিজরি বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে আপনার মালিকানায় থাকে — তাহলে যাকাত ফরজ হবে বছর পূর্তির দিন।
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত বিস্তারিত:
প্রথম নিসাব প্রাপ্তির দিন গণনা শুরু করুন
যেদিন আপনার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ (উদাহরণস্বরূপ – রূপা হিসাবে প্রায় ৬,১২ গ্রাম রূপার সমমূল্য) আসল, সেদিন থেকে এক হিজরি বছর (চন্দ্র বছর) গুনতে হবে।
বছর শেষে যদি নিসাবের চেয়ে কম না হয়
বছর শেষে যদি এখনো নিসাব পরিমাণ বা তার বেশি সম্পদ থাকে, তাহলে ওই দিন যাকাত আদায় করা ফরজ।
উদাহরণ:
১ রমজান ১৪৪৫ হিজরিতে আপনার কাছে ১০০,০০০ টাকা জমা ছিল।
এরপর পুরো বছর সেটি নিসাবের নিচে নামেনি।
তাহলে ১৪৪৬ হিজরির ১ রমজানে যাকাত ফরজ হবে।
আপনার সম্পদের ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।
টিপস:
🔹 বছরজুড়ে সম্পদ কম-বেশি হলে, শুধু বছরের শেষ দিনে আপনার মালিকানায় যদি নিসাব পরিমাণ বা বেশি থাকে — তাহলে যাকাত ফরজ।
🔹 যাকাত গ্রেগোরিয়ান সাল নয়, হিজরি সাল অনুসারে হিসাব করতে হয়।
যাকাত কাদের উপর ফরজ?
যাকাত ফরজ হয় সেই মুসলমান ব্যক্তির উপর –
✅ যার মালিকানায় এক চন্দ্র বছর (হিজরি বছর) ধরে
✅ নিসাব পরিমাণ সম্পদ (স্বর্ণ, রূপা, নগদ টাকা, ব্যবসার মাল, জমি ইত্যাদি) আছে
✅ এবং ঋণ বাদ দিয়ে নিসাব পরিমাণ থাকে।
যাকাত কাদেরকে দেয়া যাবে?
📖 কুরআনের ৮ শ্রেণি:
“যাকাত তো ফকির, মিসকিন, যাকাতকর্মী, সদৃশ হৃদয় গঠনকারী, মুক্তিপ্রত্যাশী দাস, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্য নির্ধারিত।”
📚 সূরা তাওবা: ৬০
যাকাত প্রদানের খাত কয়টি? কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুযায়ী
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কুরআন মাজিদের সূরা আত-তাওবা, আয়াত ৬০-এ যাকাত প্রদানের ৮টি খাত নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাই ইসলামে যাকাত শুধুমাত্র এই ৮ শ্রেণির মানুষকেই দেয়া যায়।
যাকাত প্রদানের ৮টি খাত (আসন)
📖 আল্লাহ বলেন:
"যাকাত তো নির্ধারিত গরিব, অভাবী, যাকাত আদায়ের কর্মী, যাদের মন আকৃষ্ট করতে হয়, দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্য—এটাই আল্লাহর নির্ধারিত বিধান।"
📚 সূরা তাওবা: আয়াত ৬০
১. ফকির (الفقير)
যারা একেবারেই নিঃস্ব, কোনো সম্পদ নেই। নিজের প্রয়োজন পূরণ করতে অক্ষম।
২. মিসকিন (المسكين)
যাদের কিছু আছে, কিন্তু প্রয়োজন মেটানোর মতো নয়। আয় আছে, কিন্তু চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
৩. আমিলিন (العاملين عليها)
যারা যাকাত সংগ্রহ, হিসাব রাখা ও বিতরণের কাজে নিয়োজিত। তারা এর বিনিময়ে পারিশ্রমিক নিতে পারে।
৪. মুআল্লাফ কুলুবুহুম (المؤلفة قلوبهم)
নতুন মুসলিম অথবা ইসলাম গ্রহণে আগ্রহী—যাদের অন্তর ইসলামমুখী করতে সাহায্য দরকার।
৫. রিক্বাব (في الرقاب)
দাস মুক্ত করার জন্য, যেমন: কোনো বন্দি মুসলমানকে মুক্ত করতে।
৬. গারিমিন (الغارمين)
ঋণগ্রস্ত, যারা হালাল কারণে ঋণগ্রস্ত হয়েছে এবং নিজে পরিশোধে অক্ষম।
৭. ফি সাবিলিল্লাহ (في سبيل الله)
আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ, দ্বীনি শিক্ষা, দাওয়াত, হজ কিংবা মাদরাসা ইত্যাদি খরচে ব্যয়।
৮. ইবনুস সাবিল (ابن السبيل)
মুসাফির, যারা ভ্রমণের পথে আটকে পড়েছে এবং সহায়তার প্রয়োজন আছে।
আরো পড়ুনঃ
সকাল ও সন্ধ্যার ২০টি জরুরি দোয়া (আরবি, বাংলা উচ্চারণ, অর্থ, ফজিলত ও হাদিসসহ)
যাদের যাকাত দেয়া যাবে না:
ব্যক্তি | যাকাত দেয়া নিষেধ |
---|---|
পিতা-মাতা | ❌ |
সন্তান (ছেলে-মেয়ে) | ❌ |
স্ত্রী বা স্বামী | ❌ |
ধনী ব্যক্তি | ❌ |
সায়্যিদ বংশভুক্ত | ❌ |
সংক্ষেপে মনে রাখুন:
যাকাতের খাত = ৮টি, যেগুলোর বাইরে যাকাত খরচ করা বৈধ নয়।
কত শতাংশ যাকাত দিতে হয়?
✅ ২.৫% (সাড়ে দুই শতাংশ)
➡️ ১ লাখ টাকা থাকলে যাকাত দিতে হবে = ২,৫০০ টাকা
যাকাতের উপকারিতা ও ফজিলত:
✅ আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে
✅ সম্পদে বরকত আনে
✅ গরিবদের অধিকার পূরণ হয়
✅ সমাজে ভারসাম্য তৈরি হয়
✅ জান্নাতের পথ সুগম হয়
📚 হাদিস:
“যে ব্যক্তি যাকাত দেয় না, কিয়ামতের দিন তার স্বর্ণ ও রূপা গরম করে তার শরীরে দাগ দেয়া হবে।”
(সহীহ মুসলিম: ৯৮৭)
উপসংহার:
যাকাত শুধুমাত্র দান নয়, এটি একজন ধনী মুসলমানের উপর আল্লাহর ফরজ করা অধিকার। তাই সময়মতো সঠিকভাবে যাকাত আদায় করুন এবং গরিব, অভাবী মানুষের পাশে দাঁড়ান।
মন্তব্য করুন
Your email address will not be published.